আমি বিরোধীদলের রাজনীতি করি

May 27, 2009

ছাত্রাবস্থায় রাজনীতি করতে হয়। ইচ্ছেয় হোক অনিচ্ছায় হোক কোন নেতার কথা ফেলা যায় না। তারা বড়ভাই, কথা না শুনলে মাইন্ড করেন, তাদের ইচ্ছের ওপর অনেককিছু নির্ভর করে। কাজেই ডাকলে একদিন তাদের সভায় গিয়ে বসতে হয়, একদিন মিছিলের সাথে হাটতে হয়। একসময় পরিচিতি হয়ে যায় অমুকে অমুক দলের কর্মী।

আরেকটি বিষয়ে রাজনৈতিক দলের কর্মী হিসেবে পরিচিতি পাওয়া যায়। অমুক নেতার আদর্শ বাস্তবায়ন করা, তার স্বপ্ন পুরন করা ইত্যাদি বিষয়ে একাত্মতা প্রকাশ করে। তারা গত হয়েছেন কয়েক দশক আগে, তাতে কি। আদর্শ রেখে গেছেন। সেই আদর্শে চলছে দেশ। যত বড় করে তাদের নাম প্রচার করতে পারবেন, জিকির করতে পারবেন তত বাড়বে আপনার মহিমা।

কোন এক রাজনৈতিক দলের সাথে আমারও সংশ্লিষ্ঠতা ছিল। তবে সংশ্লিষ্টতার ধরন একটু অন্যরকম। স্পষ্ট বক্তব্য, আমি মিছিলে, মিটিংএ যাব না। এর বাইরে কোন কাজ থাকলে সম্ভব হলে করে দেব। নিজ যোগ্যতাবলে এটুকু দাবী আদায় করা সম্ভব হয়েছিল। এর একটা সুফল এই যে নির্দিষ্ট দলের জন্য পরিচিত হলেও সব দলের সকলের সাথে ভাল সম্পর্ক ছিল। একদল আরেক দলের কর্মীকে মারার জন্য লাঠি হাতে ধাওয়া করে যাচ্ছে, আমি দাড়িয়ে আছি পাশেই, দুপক্ষের কেউই আমাকে দেখছে না। আমি এই রাজনীতির বাইরের কিছু। আমি কাউকে মারতে যাচ্ছি না, আমাকে কেউ মারতে আসছে না।

সেসব কথা থাক, আমার বক্তব্য রাজনৈতিকভাবে বিরোধী এক দলের কর্মীকে নিয়ে। কর্মি না বলে নেতা বলাই ভাল কারন তেমনটাই শুনেছি। এবং ছাত্র নেতা নন, শ্রমিক নেতা।

তার কর্মস্থল কলেজের কাছেই। সারাক্ষনই তাকে কলেজের আসেপাশে দেখা যেত। একেবারে নিবেদিতপ্রান নেতা। সকলের সাথে আলাপ করছেন। বুদ্ধিপরামর্শ দিচ্ছেন। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা কি বলতে পারি না, আমার ধারনা খুব বেশিদুর যাননি, তবুও বড় ধরনের নেতা। সবাই মান্য করে চলে।

আমার সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক এড়িয়ে চলা সম্পর্কের মত। একেবারে সামনাসামনি পরে গেলে কুশল বিনিময় হয়। এপর্যন্তই।

এরপর বহুদিন গত হয়েছে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সেই উত্তাল দিন পেরিয়ে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এসেছে। আমিও ছাত্রজীবন ছেড়ে কর্মজীবনে। রাজনীতির সাথে সামান্যতম সম্পর্কও নেই।

কাছাকাছি যাওয়ায় একবার শখ হল, সেই চেনা পরিবেশটা দেখে যাই। যে হোটেলে চায়ের কাপ সামনে নিয়ে একসময় এখানে দিনরাত কাটিয়েছি সেটা এখন কেমন আছে। পরিচিত কজন এখনো টিকে আছে এখানে। প্রথমেই দেখলাম হোটেলের মালিক বদল হয়েছে। আগের সেই আন্তরিকতা নেই। এককাপ চা নিয়ে বসে দেখতে শুরু করলাম আগের কি আছে, কি নেই। এমন সময় তিনি দেখা দিলেন। আমাকে দেখে দ্রুত এগিয়ে এলেন, আরে কেমন আছেন ?

ভাল।

তিনি বসলেন আমার সামনে। আমি আরেককাপ চা দিতে বললাম।

আপনি তো ঢাকা থাকেন। অমুক ভাইয়ের সাথে আপনার দেখা হয় ?

উনার বিরোধী দলের নেতার নাম করছেন। বললাম, না। পরিচিত কারো সাথেই আমার যোগাযোগ নেই।

তিনি বললেন, ঢাকা গেলে উনার সাথে দেখা করব।

আমি একটু ঘুরিয়ে বললাম, এখন তো আপনার দল ক্ষমতায়।

তিনি বললেন, আমি বিরোধীদলের রাজনীতি করি।

অবাক না হয়ে উপায় থাকল না। এমন নিবেদিতপ্রান নেতা নিজের দল ছেড়ে বিরোধী দলে গেলেন। কারন কি ? নিশ্চয়ই নেতারা ক্ষমতায় গিয়ে তার কথা ভুলে গেছেন। প্রাপ্য মর্যাদা দেননি। তাকে কখনো খারাপ কাজে জড়িত হতে দেখিনি। একমাত্র রাজনীতিতেই নিবেদিতপ্রান। এমন নিবেদিতপ্রান নেতার নিশ্চয়ই কিছু প্রাপ্য ছিল। সেটা না পেয়ে মনে দুঃখ পেয়েছেন।

জিজ্ঞেস করলাম, কেন ?

চা আসায় কাপটা হাতে নিয়ে তিনি বিব্রতভাবে নাড়তে থাকলেন। কিভাবে বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। একসময় গলার স্বর আরো নিচু করে বললেন, দেখুন রাজনীতি করতে আমার ভাল লাগে। সরকার কি দোষ করল এসব কথা বললে মানুষ সচেতন হয়। কথা শোনে। সেকথা যদি না বলতে পারি তাহলে রাজনীতি করে লাভ কি ? ঠিক করেছি সবসময় বিরোধী দলের রাজনীতিই করব।

তাকে দেখলাম ভাল করে। একেবারে সাধারন পোষাক, সাধারন চেহারা। আমার এখনো মনে হচ্ছে এই শ্রমিক নেতা বেশিদুর লেখাপড়া করেনি। যাকিছু শিখেছে বাস্তবতা থেকে। এবং সতিসত্যিই শিখেছে। বহু বড়বড় নেতার দেখা পেয়েছি। ছাত্রনেতা থেকে শুরু করে দলের প্রধান পর্যন্ত। বহু বুদ্ধিজীবি সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়েছে। সামনাসামনি থেকে খবরের কাগজ-টিভিতে। বহু বিশেষজ্ঞেন পরিচয় পেয়েছি তাদের কথায়-লেখায়। এমন সরলভাবে এই বক্তব্য কারো কাছে পাইনি।

যতদুর মনে পরে তাকে সবাই টিপু নামে ডাকত।

0 comments:

 

Browse