ভরদুপুরে মাইকের শব্দ শুনে চমকে উঠলাম। এই গ্রীষ্মের কাঠফাটা দুপুরে মাইক নিয়ে মা-বোনদের জাগাতে এল কে। দুপুরে ঘুমাতে হয় না। এতে শরীর ভারী হয়। অপুষ্টির চেয়ে স্থুলরোগ বড় সমস্যা। এখনো ইউরোপিয়ানদের, আমেরিকানদের মত, এমনকি বলিউডের মত স্বাস্থ্য সচেতনতা গড়ে ওঠেনি। শহরে এখনো যথেষ্ট পরিমান ফিটনেস সেন্টার তৈরী হয়নি। এখন একমাত্র পথ নিজেকে নিজে বাচানো। দুপুরে না ঘুমানো।
কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম। কে এই জনদরদী। নিশ্চয়ই নাম জানাবে।
‘সমাবেশে দলে দলে যোগ দিন।’
অবাক হলাম শুনে। কিসের সমাবেশ সেটা কানে পৌছেনি। মা-বোনদের সমাবেশ হয়তো। নিশ্চয়ই আন্তর্জাতিক কোন দিবস। আযোজন করেছে কোন মোবাইল কোম্পানী।
‘আবাসিক এলাকা ফিরিয়ে দাও।’
মুহুর্তে বিষয়টা পরিস্কার হয়ে গেল। আবাসিক এলাকায় যেন আবাসিক এলাকার পরিবেশ বজায় থাকে তারই সমাবেশ। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রাখা চলবে না। জানজট চলবে না। তিন ইউ আহমেদের রাজত্বকালে একথা শুনেছিলাম। ঘোষনা দেয়া হয়েছিল, আবাসিক এলাকায় কোন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থাকতে দেব না। দুমাসের মধ্যে তাদেরকে সরে যেতে হবে। ট্রেড লাইসেন্স দেয়া হবে না। এখনো দেয়া হয়না, অতিরিক্ত টাকা না দিলে।
তবে, যারা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু করেন তাদের অতিরিক্ত টাকার অভাব নেই। কেন্টাকি চালু হয়েছে। রাস্তা দুপাশ তার পার্কিং এর যায়গা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। রাত যত বাড়ে গাড়ির ভিড় তত বাড়ে। শুনেছি একটা ফ্লোরে নাইট ক্লাব রয়েছে। রাতের বেলা কাচের মধ্যে দিয়ে রঙিন আলোর নাচানাচি দেখা যায়। যাদের ঢোকার সামর্থ্য নেই তারা রাস্তায় দাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করে যদি কাচের ফাকে কিছু নজরে পড়ে। কানাঘুসা করে ওখানে ঢুকতে কত খরচ হয়। টাকা দিতে হয় না ডলার। যাদের ঢুকতে বেরতে দেখি তাদের টাকা-ডলার কোনটারই সমস্যা নেই এটা নিশ্চিত। এরা স্কুলের বেতনও ডলারে দেয়। পাশ করে বিল গেটস-মেলিন্দা গেটস ছাড়া অন্যকিছু হতেই পারে না।
ইউ আহমেদ ত্রয় এই অবস্থার পরিবর্তন চেয়েছিলেন। রাস্তাগুলি ওয়ান ওয়ে করা হল। একদিক দিয়ে যাবে অন্যদিক দিয়ে আসবে। হলুদ জামা গায়ে কম্যুনিটি পুলিশ দাড়িয়ে গেল লাঠি হাতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। গাড়ির যাত্রী, রিক্সাযাত্রী, গাড়িচালক, রিক্সাচালক সকলের মুখে এককথা, এই একটু সামনে যাব। তারপর ঠেলেঠুলে চলে যায় তাকে উপেক্ষা করে। এক গাড়িযাত্রীকে যেতে দেব না বলায় নেমে তার মাথা ফাটিয়ে চলে গেল। সত্যিকারের পুলিশ এল। তবে তাদের অভিজ্ঞতা বেশি। গাড়ি দেখেই চেনেন কি করতে হবে। তখন রেসলিংএর রেফারীর মত অন্যদিকে মুখ করে রাখেন। কিছুদিনের মধ্যেই সবাই ভুলে গেল জারি করা নিয়ম, ইউ আহমেদরা ইউটার্ন নিলেন, সব বরাবর হয়ে গেল। যেদিকে খুশি যান, যেখানে খুশি গাড়ি রাখুন। একটাই নিয়ম, বড়র সাথে লাগবেন না। রিক্সা থেমে থাকলে তাকে সরিয়ে গাড়ি রাখুন আর আরো দামি গাড়ি এলে সরে যায়গা করে দিন।
‘জাগো, মায়েরা জাগো। জাগো, বোনেরা জাগো।’ বলতে বলতে মাইকের শব্দ দুরে সরে গেল। আমিও একসময় ভুলে গেলাম মাইকিংএর কথা।
পরদিন বিকেলে, রোদের তাপ তখনো কমেনি, রাস্তায় বেরিয়ে প্রথমেই চোখে পরল লাঠিহাতে পুলিশ। গাড়ি ঘুরিয়ে দিচ্ছে। তারপরই চোখে পরল ১৫-২০ জনের দল। হাতে ব্যানার নিয়ে দাড়িয়ে রয়েছেন। রাস্তা বন্ধ। তাদের সামনে হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে এর উদ্দ্যোক্তা।
তাকে একবার দেখলাম ভাল করে। শরীরে গড়ন, পোষাক-আষাক, অঙ্গভঙ্গি দেখে মনে হল একসময় কেউকেটা ছিলেন। হয়ত এখনো আছেন। তবে গলা শুনে প্রথমেই যা মনে হল, এমন পরিবেশে বক্তৃতা দিয়ে অভ্যস্থ নন। এখনো জ্বালাময়ী বলার পর্যায়ে পৌছেননি। তবে কন্ঠে দৃঢতা রয়েছে।
‘আমরা ধানমন্ডিকে বানিজ্যিক এলাকা বানাতে দেব না। আপনারা জাগুন। অনেক সহ্য করেছেন আর নয়।’
আমি তার আহ্বানে কারা এসেছেন দেখার চেষ্টা করলাম। বিশেষ করে মা-বোনদের দেখার চেষ্টা করলাম। তার একেবারে পাশে রয়েছেন দুতিনজন। ওদিকে বিল্ডিংএর ছায়া রয়েছে। বাকিরা তাদের মুখোমুখি। সোজা মুখে এসে পরেছে রোদ। চোখমুখ কুচকে, মাথা নিচু করে কোনমতে সহ্য করছেন। বোঝা যাচ্ছে কেউই এই প্রচন্ড গরমে এসির বাইরে এসে খুশি নন। আরেকটু পরে শুরু করলে হত না! সন্ধ্যের পর। বেশ ঢুরফুরে হাওয়ায় সন্ধ্যেটা কাটানো যেত।
এর উদ্দ্যোক্তাই আমার মনোযোগ আকর্শন করল বেশি। ধবধবে পোষাক। পথে নেমেছেন এলাকাবাসির উপকার করতে। এই এলাকাকে তিনি বস্তি বানাতে দেবেন না, আভিজাত্য বজায় রাখবেন।
কিন্তু তিনি এই দায়িত্ব নিলেন কেন ?
বকারামের মাথায় কুচিন্তা বেশি খেলে। মনে হল যা কামানোর তা তো কামিয়েছেন, এখন দেশের জন্য জনগনের জন্য, সমাজের জন্য কিছু করা উচিত। তাছাড়া বসে খেলে রাজার ধণও ফুরিয়ে যায়। সেঝুকি নেয়ার চেয়ে বরং একটু হেটেফিরে খাওয়া ভাল। মুলধন যা রয়েছে তাতে ঝুকি নেয়াই যায়।
‘আমরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলনে যাব। কোন বাধাই আমাদের দমাতে পারবে না। আমরা আমাদের অধিকার আদায় করবোই করব।’
এই ব্যক্তি যখন নিয়মের কথা বলছেন তখন প্রশ্ন এল মনে, তিনি কিভাবে সেটা করবেন ? নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন কি জিনিষ ? সবসময়ই শুনেছি শান্তিপুর্ন মিছিলে পুলিশের হামলা, সবসময় দেখেছি শান্তিপুর্ন মিছিল থেকে গাড়ি ভাঙা, দোকান ভাঙা, আগুন লাগানো, পুলিশের দিকে ঢিল ছোড়া। এইসব এসিরুমে বাসকরাদের লোকদের নিয়ে তিনি কি সেটা করতে পারবেন ? এজন্য তো নেতাই রয়েছে। যখন থেকে মানুষ সমাজে বসবাস করতে শুরু করেছে তখন থেকেই নেতৃত্বের বিষয়টিও শুরু হয়েছে। কিছু ব্যক্তি তাদের জ্ঞান, মেধা, অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা দিয়ে ঠিক করবেন কিভাবে চললে সমাজ ভালভাবে চলবে। অন্যরা তার কথা মেনে চলবে। বিপদে পড়লে তারকাছে দৌড়ে যাবে আর তিনি সমাধান বলে দেবেন। এমন নীতির প্রচলন করবেন যারফলে দেশ এগিয়ে যাবে। মানুষ সন্মান নিয়ে মাথা উচু করে চলবে। ভেনেজুয়েলায় নাকি বহু স্কুল রয়েছে সঙ্গিত শেখানোর। অনেক যায়গায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা হাজারের ওপর। বয়স শুরু ২ থেকে। এরা এসেছে সমাজের একেবারে নিচুতলা থেকে। অনেকে খেতে পায় না এমন পরিবার থেকে। মনে হতে পারে দেশকে ক্লাসিকাল মিউজিকে পরিচিত করার জন্যই এই উদ্দ্যোগ। তা-তো বটেই। বয়স বিশ বছর পেরনোর আগেই কেউ কেউ বিশ্বখ্যাতি পেয়েছে বেটোভেন বিশেষজ্ঞ হিসেবে। বিশ্বের যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার যোগ্যতা অর্জন করেছে। তারপরও সে শিক্ষকতা করে কারাকাসে। সেটা নাকি তারকাছে পুনর্জন্ম। আর তাদের মতে এই ব্যবস্থা বিপুল পরিমান মিউজিশিয়ান তৈরী করা না, বরং তাদেরকে মানুষ করে তোলা। পাচ বছরের একজন শিশু যখন বেটোভেনের সুর তুলে হাততালি পায় তখন সে ভাবতে শুরু করে সে সাধারন মানুষ নেই। সে মিউজিশিয়ান। মানুষ তার বাজনা শুনতে আসে। তার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। দলগতভাবে থাকতে শেখে, একসাথে কাজ করতে শেখে। তার বাবা-মা ভাবতে শুরু করে তার সন্তান আর বস্তির না খেয়ে থাকা বালক নেই। অভাব হয়ত এখনো যায়নি কিন্তু সে লাভ করেছে মর্যাদা। বুশ-স্যাভেজ যত দা-কুমড়ো সম্পর্কই থাকুক না কেন, বুশসাহেব এটা শিখে নিতে ভুল করেননি। এর মডেল চালু হয়েছে নিউইয়র্কেও।
তিনি সেপথে যাচ্ছেন না কেন ? কোন দেশে, কোন সমাজে কিভাবে কি হয়েছে দেখা প্রয়োজন মনে করছেন না কেন ? না-কি তিনি নতুন কিছু আবিস্কার করে দেখাবেন ? নেতা তো ঠিকই রয়েছেন। শতশত, হাজার হাজার। কে কাকে ফেলে নেতৃত্ব দেবেন তা নিয়ে প্রতিযোগিতা চলছে। রীতিমত লড়াই করে নেতৃত্বের সামনে যেতে হয়। না-কি সেই নেতৃত্ব তার পছন্দ হচ্ছে না।
হবেই বা কেন ? ছেলের বয়সি একজন ভোট পেয়ে সব মাতব্বরি করবে এটা মেনে নেয়া যায় ? তারকাছে মাথা নিচু করে গেলে ইজ্জত থাকে ? আর তাদের কানে কথা তুলেই বা লাভ কি ? তাদের এসব দেখার সময় আছে ? তাদের কত কাজ। দেশ, জনগন, গণতন্ত্র, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, আরো কত কি- আর, কতজনের তো কান কাটা। এককান কাটা গেলে নাকি সেটা চুল দিয়ে আড়াল করে। দুকান কাটা গেলে কানে বাতাস ঢোকে না। এদিক ওদিক দিয়ে পাশ কাটিয়ে যায়। যোগাযোগ মন্ত্রী ঠিক করেছেন তিনি কোটি টাকার গাড়িতে বেড়ানোর খায়েস মেটাবেনই মেটাবেন। কে কি বলল তাতে কি যায় আসে। তিনি কি উলফোভিতজ না ব্লাংকেট। জোট সরকারের মন্ত্রীও নন। সে ব্যাটা জানে না গাড়ি কিভাবে নিতে হয়। শেষে আমও গেল ছালাও গেল। তিনি খুটি গেড়ে বসতে শিখেছেন। মনে মনে বলেন, ব্যাটারা কথা বলার যায়গা পায় না। ইলেকশনের সময় তারা কি বাপের টাকা খরচ করেছে ? তারা কি জানে কি করলে মন্ত্রী হওয়া যায় ? হয়ে দেখাক তো!
এমন নেতার কাছে গেলে লাভ কি হবে ?
তারচেয়ে নিজে নেতা হওয়া ভাল। চেষ্টা করলেই হওয়া যায়। দরকার একটু প্রচার, একটু প্রসার, একটু খরচ। যতটুকু করলে টিকিট পাওয়া যায়। মেনন ভাই দেখিয়েছেন নদী পার হওয়ার জন্য সাতার কাটা প্রয়োজন নেই, নৌকায় উঠলেই হয়।
তিনি বলছেন, ধানমন্ডির একুশটা আউটলেট রয়েছে। প্রয়োজনে আমরা সবগুলো বন্ধ করে অবস্থান ধর্মঘট করব। কোন অফিসের যানবাহন চলতে দেব না। ধানমন্ডিতে যানজট লাগতে দেব না।
মনে মনে বললাম, যানজট তো লাগিয়েই রেখেছেন। ডজন দুয়েক পুলিশ হিমশিম খাচ্ছে সেই জট ছাড়াতে। আর গাড়ি যদি চলতে থাকে তাহলে জটই বা লাগে কিভাবে ? নিউইয়র্ক-লন্ডনে কি এরচেয়ে কম গাড়ি চলে ? যে গাড়ি ঘন্টার পর ঘন্টা পথের অর্ধেক জুড়ে থেমে থাকে জট তো সেইই লাগায়। আপনার কয়েকগজ দুরেই দেখুন না রাস্তার দুপাশ গ্যারেজ হয়ে রয়েছে। আপনার বাড়ির গেট বন্ধ। এটা বন্ধ করুন না কেন ? এজন্য আইনও তো রয়েছে। পুলিশ নিজে যখন করবে না তখন নিজেই একটা মামলা দিন অবৈধ পাকিংএর। দেশে এখনই আইন-আদালত রয়েছে। অন্তত তাদেরকে কৈফিয়ত দেয়ার জন্য তলব করা হয়নি।
পরক্ষনেই মনে হল, মামলা করা তার আওতার বাইরে। কেন্টাকির মালিক আর গাড়ির মালিকের ক্ষমতা তারচেয়ে অনেক বেশি। এরা সবাই বাংলার বাঘ। যেচে বাঘের সাথে লড়তে যায় কে ? তারচেয়ে এখানে বক্তৃতা দেয়া ভাল। বেশ পরিচিতি পাওয়া যাচ্ছে। খবরের কাগজে কি ছবি উঠবে ? আরে একটা টিভি চ্যানেলের গাড়ি এইসময় যায় না কেন ? ব্যাটারা কত টাকা নেয় খবর দেখাতে ?
চলতে থাকল বক্তৃতা। আমি হাটতে হাটতে এগিয়ে গেলাম আর যতদুর কানে আসে শুনতে থাকলাম।
হঠাৎ করে আগের দিনের মাইকিংএর কথা মনে হল। জাগো, মা-বোনেরা জানো।
নেতারা সাধারনত ভাইসব, প্রিয় এলাকাবাসি এসব দিয়ে শুরু করেন। ইনি বিশেষভাবে মা-বোনের দিকে দৃষ্টি দিলেন কেন ? যতদুর জানি তারা এখনো মিছিলে সংখ্যালঘিষ্ট।
নাকি দেশের প্রধানমন্ত্রী মহিলা, বিরোধীদলের নেতা মহিলা, স্বরাষ্ট্র-পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহিলা বলে এদিকেই সম্ভাবনা দেখছেন। ধারনাটা মন্দ না। মা-বোনদের জাগার এখনই সময়।