মৃত্যুর পর দুব্যক্তিকে একসাথে থাকতে দেয়া হল (বেহেসত অথবা দোযখ যেখানেই হোক)। কিছুক্ষনের মধ্যেই তাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিল। রীতিমত গন্ডগোল। সেই গন্ডগোল থামানোর জন্য একজন প্রহরী পাঠাতে হল। তিনি এসে বললেন, আপনারা একই দেশের, একই ভাষার, একই পেশার গুনিজন। দুজনেই নামকরা বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত। আপনারা নিজেদের মধ্যে গন্ডগোল করছেন কেন ?
উত্তর পাওয়া গেল, আমাদের একজন আওয়ামী বুদ্ধিজীবী আরেকজন জাতিয়তাবাদী।
বিষয়টা যদি আওয়ামী এবং জাতিয়তাবাদীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত তাহলে হয়ত এর বাইরের সকলে স্বস্তি পেত। কিন্তু সেটা হয় না। খেলা দেখতে বসলে এইদল নয়ত ওইদলকে সমর্থন করতে হয়। সমাজের খেলা যখন চলে তখন দর্শককেও সেই খেলা সমর্থন করতে হয়। ফলে আরেকজনের বিরোধীতা চলে আসে। একজন দুঃখ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নমুনার কথা লিখেছিলেন পত্রিকায়। একদল মিছিল করছে। শ্লোগান, মীরজাফরের দালালেরা হুশিয়ার সাবধান। যাদের সম্পর্কে এই বক্তব্য তারা কাছেই ছিল। মুহুর্তের মধ্যে আরেকটা পাল্টা মিছিল শুরু হল, সিরাজদৌলার দালালেরা হুশিয়ার সাবধান। আপনি যদি লীগের সমালোচনা করেন তার অর্থ আপনি জাতিয়তাবাদী দালাল। নয়ত রাজাকার। স্বাধীনতার শত্রু। আর যদি জাতিয়তাবাদীর সমালোচনা করেন তাহলে লীগপন্থি। ভারতের দালাল। আপনি আমাদের দলে নয়ত সন্ত্রাসী, বলে গেছেন বুশ।
দালালদের হুশিয়ার-সাবধান করতেই হয়। সন্ত্রাসীদের কালোহাত ভেঙে দিতেই হয়। সরকারের গদিতে একসাথে আগুন লাগাতেই হয়। আর সেকারনে একজোট হতে হয়। আরেক জোটের বিরোধীতা করতে হয়। আপনি বাঙালী, তাহলে আমরা বাংলাদেশী। স্বাধীনতা ঘোষনা করেছে কে ? আমার নেতা। কখনো যদি এইদল ছেড়ে ওইদলেও যান কথা পাল্টাবে না। ভদ্রলোকের এককথা।
মৃত্যুর পর ওয়েটিংরূমে অপেক্ষা করছে কিছু মানুষ। অন্যরা আসছে-যাচ্ছে। একজন কৌতুহলি হয়ে জিজ্ঞেস করল, এরা অপেক্ষা করছে কেন ? উত্তর হল, এরা বাঙালী না বাংলাদেশী তা এখনো ঠিক হয়নি।
স্বাধীনতার পর কোন ভদ্রলোক কোন মুহুর্তে বলেছিলেন যুদ্ধে ৩০ লক্ষ মানুষ মারা গেছে। একথা পাল্টানো যাবে না। এতে স্বাধীনতার খর্ব হয়, ত্যাগ কম করে দেখা হয়। যারা যুদ্ধের নিহতদের হিসেব কষেন তারা বললেন ১৯৭১ সালের যুদ্ধে বাংলাদেশে মারা গেছে ৫ থেকে ৬ লক্ষ মানুষ। স্বাধীনতার পর একবার জরিপের কাজ শুরু করা হয়েছিল, তাতেও ফলটা এগোচ্ছিল সেদিকেই। সাথেসাথে জরিপ বন্ধ করে দেয়া হল। এত কম মারা গেলে মর্যাদা থাকে কোথায় ? যা চালূ আছে সেটাই থাক না। কেউ মাটির নিচ থেকে উঠে এসে তো প্রতিবাদ করছে না।
সারা বিশ্ব বলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সবচেয়ে বেশি প্রানহানি হয়েছে উগান্ডা-রুয়ান্ডায়। ১০ লক্ষ মানুষ মারা গেছে সেখানে। আমরা তাদের থেকে পিছিয়ে থাকতে পারি না। দেশের মর্য্যাদা বলে কথা।
বিবিসি বাংলাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয়। পৃথিবীর অনেক দেশে যখন শ্রোতা কমে যাওয়ায় সার্ভিস বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সেখানে বাংলাদেশে সময় বাড়ানো হয়েছে। বাংলাদেশের সমস্ত খবর তিনবারে প্রচার করা যায় না, চারবারে প্রচার করতে হয়। আর সারাদিনের জন্য ইংরেজি বিভাগ তো রয়েছেই। তারাই প্রতিবেদন প্রকাশ করে, ঢাকায় বিএমডব্লিউ এর শোরুম নিয়ে। আন্তর্জাতিক সংস্থার টেলিফোন লাইন অকেজো থাকার পরও কয়েক লক্ষ টাকার বকেয়া বিল দাবী করা নিয়ে, বৃহত্তম এনজিও অন্য দেশের মানুষের সেবা করতে যাবে তাই নিয়ে।
বিবিসি এবং অন্যান্য সংবাদমাধ্যম যখন এসব তথ্য প্রকাশ করে তখন স্পষ্ট বিদ্রুপ ধরা পরে তাদের কন্ঠস্বরে। নিজেরাই মাইক্রোফোনের সামনে হাসাহাসি করেন, যেদেশে তিনজনে একজন খেতে পায় না সেদেশে লক্ষ ডলারের গাড়ি কেনে কে। যে শহরে রিক্সা স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারে না সেখানে রেসিং গাড়ি কিভাবে চলে। সরাসরিই প্রশ্ন করেন মন্ত্রীকে, লাইন বন্ধ থাকায় যে বিল করা হয়েছে সেটা কি দিতে হবে ? মন্ত্রী বলেন বিল যখন হয়েছে তখন দিতে হবে বৈকি। চুরি সব দেশেই হয়। অন্য দেশে মিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ফ্রড হয়। এদেশে মানুষ গরীব, অত টাকাপয়সা নেই, অত সুযোগ নেই। সেজন্যই এই সামান্য চুরি। তারা সমাজ সেবককে প্রশ্ন করেন আপনারা আফগানিস্তানে সেবা করতে যাবেন, অর্থ যোগান দেবে কে ? আপনাদের নিজেদের থাকা-খাওয়া-আনন্দ-ফুর্তি-যাতায়াতের খরচ তো যায় এদিক থেকে। ডলার-পাউন্ড ইউরোতে। তার উত্তরও তৈরী। আমরা জনবল দেব, অর্থবল আপনাদের।
বিদ্রুপ আরো ষ্পষ্ট করে প্রকাশ পায় যখন সরকার-নেতা-বুদ্ধিজীবী নানারকম বুলি আওড়ান। সারা বিশ্ব যে নিয়মে চলেছে, ইতিহাস যে নিয়মে চলেছে, এখনো চলছে তার বাইরে নতুন পদ্ধতি আবিস্কারের কথা শোনান। দেশে এমন গনতন্ত্র চালু করবেন যা কখনও কোথাও কেউ দেখেনি। রাজনীতিতে গুনগত পরিবর্তন তারা আনবেনই আনবেন। আগে যে নিয়মে দেশ চলেছে (কে চালিয়েছে প্রশ্ন করবেন না) সেই নিয়মে চলবে না। একেবারে নতুন, টাটকা নিয়ম এনে হাজির করব। সারা বিশ্ব দেখে শিখবে আমরা কি করতে পারি। দেশে সংসদীয় গনতন্ত্র তবে তার নেতা যতদিন জীবিত থাকবেন ততদিন তার বিকল্পের কথা ভাববেন না। এতে নেতার মান থাকে না। একসময় তিনি উত্তরাধিকারী রেখে যাবেন। অন্য যারা থাকবে তাদের একমাত্র কাজ তোসামুদি করা। পেটে খেলে পিঠে সয়, কাজেই তাদের আপত্তি কিসের ?
আবারো সেই দোজখের গল্প। বিবিসি জরিপ করল বিশ্বের সেরা কৌতুক কোনটি। জরিপের ফল প্রকাশ করা হল বিবিসি বাংলা বিভাগে। প্রকাশের পর প্রতিবেদক নিজেই নিজের পছন্দের সেরা কৌতুক পরিবেশন করলেন। এমন এক দেশের মানুষের দোজখের গল্প করলেন যে দোজখে পাহারাদার প্রয়োজন হয় না। কেউ বের হতে চেষ্টা করলে অন্যরা তার পা ধরে টেনে রাখে। গল্প শেষে বললেন, আপনি ইচ্ছেমত দেশের নাম বসিয়ে নিতে পারেন।
আমরা আর হাস্যকর হতে চাই না।