প্রায়ই খবরের কাগজে দেখি গোল টেবিল, লম্বা টেবিল, চৌকো টেবিলের খবর। নানারকম মুখ, নানারকম মন্তব্য। কখনো একই মুখ ঘুরেফিরে আসে, কখনো একেবারে টাটকা নতুন মুখ। টাটকা বক্তব্য। যিনি জীবনে কাঠে একটা পেরেক ঠোকেননি তিনি জানিয়ে দেন ঠিক কোন কারিগরী পদ্ধতিতে দেশ উন্নতির শিখরে পৌছবে, যিনি চেয়ার-টেবিল বই-পত্র ছাড়া ঘরের বারান্দায় দাড়িয়ে বাইরের চেহারা দেখেননি এবং এখনও দেখেন না, গাড়ির কাচের ভেতর থেকে যতদুর দৃষ্টি যায় ততটুকুই দেখা তিনি ব্যাখ্যা দেন সমস্যা সমাধানের জন্য এদেশের মানুষকে কি করতে হবে, যিনি সারাজীবন অধনস্থ পুলিশকে ব্যবহার করেছেন সরকারের তোষামুদিতে, নিজের ব্যক্তিগত চাকর হিসেবে তিনি জানিয়ে দেন এদেশের প্রশাসনের উন্নতিতে কি করা কর্তব্য, মানবাধিকার রক্ষার জন্য ঠিক কি করা উচিত, যিনি সারাজীবন বিচারের রায় লেখার আগে খোজ নিয়েছেন তার ফলে কে অসন্তুষ্ট হবে, কে সন্তুষ্ট হবে, কার কতটুকু ক্ষতি হবে তিনি উপদেশ দেন কিভাবে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা যায়, যিনি সবসময় সভার মধ্যমনি থেকেই অভ্যস্থ, কোনকারনে সামান্যতম বিচ্যুতি হলে যার অসন্তোস ঢাকা থাকে না তিনি জানিয়ে যান সমাজ নিয়ে তিনি কত আশাবাদী। প্রতিদিন, প্রতিমুহুর্তে সমাজ সাফল্যের পথে এগিয়ে চলেছে। আপনারা সকলে অংশ নিন, তাহলেই দেখবেন-
সবাই বলেন করতে হবে, তোমরা কর। আমি বলে দিচ্ছি সমাধান এপথেই। আগে পত্রিকার পাতা জুড়ে থাকত, এখন টিভির পর্দায়ও দেখা মেলে। পার্থক্য তেমন নেই। এই টেবিলের চারিদিকে যারা বসে সেইদলে থাকেন দুই মাধ্যমেরই মালিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। তাদের নিজের ছাগল তারা গলায় কাটবেন না লেজে কাটবেন তাতে কার কি বলার থাকে। কে আছে বাধা দেয়।
একজন ব্যক্তি, যিনি সৎ, তিনি কি রাস্তার মাঝে এসে দাড়িয়ে বলবেন আমি সৎ। আমি চুরি করি না। কিংবা আমি চুরি করব না। তিনি কি চোর নন একথা প্রচারের জন্য চুরি থেকে বিরত রয়েছেন। কিছু মানুষের জন্য সেটা সত্য। হয়ত অধিকাংশ মানুষের জন্য। কেউ যখন বলেন অমুকে দুনম্বরী করে কোটিপতি হয়ে গেল তখন তার কথার মধ্যে কোন সুর বাজে তা ধরা যায়। কারো সুর হচ্ছে অমুকে সুযোগ পেল আমি পেলাম না কেন। কারো সুর বলে তারমত চক্ষুলজ্জা ত্যাগ করলে আমার এই অবস্থা হত না। নিদেন পক্ষে একজন নেতা মামা-দুলাভাই যদি থাকত। দেখিয়ে দিতাম কার যোগ্যতা বেশি। কেউ চুরি করে না সুযোগ নেই বলে, কেউ করে না ধরা পরার ভয়ে, সমর্থন করার মত কেউ নেই বলে, কেউ পারে না চক্ষুলজ্জার কারনে। এরই মাঝে দুচারজন মানুষ রয়েছে যারা চুরির সুযোগ থাকার পরও চুরি করেন না। কারন-
কারন সেটা অন্যায়। সেটা অনৈতিক। সেটা ধর্মবিরোধী। সেটা সমাজের জন্য ক্ষতিকর। আমি চুরি করব না, একথা বলে এইসব অহংকারী মানুষ না খেয়ে উপোষ করেন, ছেলেমেয়েকে দরিদ্র স্কুলে পাঠান, সারাদিনের কাজ শেষে রাতে নিজেই পড়াতে বসেন, বছরের শুরুতে পুরাতন বই খোজ করেন। একটামাত্র আশাকে সম্বল করে, তার সন্তান তার মতই হবে। সে ধনী হবে না, ধনীর পেছনে ঘুরবে না। খেয়ে হোক, না খেয়ে হোক, একা নিজের কাছে হোক, নিজেকে বলবে আমি কোন অন্যায় করিনি। এই ধারনাকে প্রাণশক্তি করে জীবন কাটাবে।
সেই ব্যক্তি রাস্তার মোড়ে এসে কেন চিৎকার করে বলবে আমি সৎ।
বলবে না। শতভাগ নিশ্চিত, হাজারভাগ নিশ্চিত, বলবে না। বলার কোন কারন নেই। বলার কোন প্রয়োজন নেই। তার পরিচয় তিনি জানেন, তার প্রিয়জন জানে, আর জানেন অন্তর্যামী।
তবু বলা প্রয়োজন হয়। তারা বলেন, না বললে যাদের সম্পর্কে লোকে নানারকম কুকথা বলে। বলতে হয় কারন এতে পরিচিতি বাড়ে, জনগন চেনে, ভোটাররা চেনে। বলতে হয় কারন সমাজের ভালর জন্য কাউকে না কাউকে কাজ করতে হয়। সমাজসেবি হতে হয়। মানবতাবাদী হতে হয়। জহির রায়হান লিখেছিলেন বণ্যায় বাধ ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখে একদল মানুষ সারারাত জেগে দলধরে মোনাজাত করলেন, সৃষ্টিকর্তার কাছে রক্ষা চেয়ে কান্নাকাটি করলেন, সকালে বেরিয়ে দেখলেন বাধ ভাঙেনি। প্রার্থনার কি মহিমা।
তাদের অগোচরে কিছু মানুষ সারারাত জেগে কঠোর পরিশ্রম করে সেই বাধ রক্ষা করেছে সেকথা তারা জানল না।
এদের কথা কেউ জানে না। কারন তারা প্রকাশ করে না। তারা অগোচরে থাকে। সমাজ যখন সাপের দংশনে নিল হয়ে থাকে সেই বিষ থেকে সমাজকে রক্ষা করার পরও তারা আড়ালে থেকে। সামনে আসে না।
কখনো কোন সমাজ যদি তাদেরকে সামনে আনতে পারে সেই সমাজ ইতিহাসে যায়গা করে নেয়। সেই সময় ইতিহাসে লেখা থাকে অমুক সভ্যতা হিসেবে। পৃথিবীর সমস্ত সভ্যতা একথাই বলে গেছে।
0 comments:
Post a Comment