বাঘ-সিংহ-জিরাফ- চিতাবাঘ সব একেএকে বিদায় নিচ্ছে। কবে শুনব সেখানে মডেল টাউন গড়ে উঠেছে। আগেই অন্তত একবার ঘুরে আসা উচিত চিড়িয়াখানায়। একবারও চিড়িয়াখানায় যাব না তাও কি হয়! একদিন মিনিবাসের ‘চিড়িয়াখানা’ ‘চিড়িয়াখানা’ ডাক শুনতে শুনতে তাতে উঠেই পরলাম। ক্ষতি কি, খাঁচার মধ্যে ঢুকিয়ে তো দেবে না। সেখানে রাখলে খাওয়ানোর দায়িত্বও নিতে হবে। আগের আপদরাই যখন মরছে তখন আর নতুন করে আপদের দায়িত্ব নেবে কে। কাজেই ঘোড়ায় চড়িয়ে মর্দ হাটিয়া চলিল, আমিও মিনিবাসে চড়ে হাটিয়া চলিলাম। এবং একসময় পৌছেও গেলাম।
যেখানে নামলাম সে যায়গাটা দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। চমৎকার। এটা কি ঢাকা শহর! এমন যায়গা দেখতে আমি প্রতিদিন আসতে পারি। চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। শুধু গাছপালা। শুনলাম পাশেরটির নাম বোটানিক্যাল গার্ডেন। ওখানে ঢুকতে পয়সা লাগে না। ঢুকে ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়ানো যায়, বসে থাকা যায়, হাওয়া খাওয়া যায়, এমনকি দুর থেকেই দুএকজনকে দেখলাম বসে থেকে একটা করে ঘাস তুলে মুখে দিচ্ছে। সত্যিই চমৎকার। চিড়িয়াখানা থেকে বের হয়েই ওখানে ঢুকতে হবে।
‘ঢাকা চিড়িয়াখানা, মীরপুর’ এইই লেখা আছে এক যায়গায়। বেশ কিছুটা উঁচুতে। অনেক দুর থেকে দেখা যায়। সাদাটে পিলার দিয়ে যতটা সম্ভব উচু করা হয়েছে। আমার মনে হল রঙটি বোধ হয় অন্যরকম হলে ভাল হত। চারিদিকে সবুজের মধ্যে সাদা, কেমন যেন চোখে লাগে। ছবিতে অন্য দেশের চিড়িয়াখানা দেখেছি। সেগুলি কেমন যেন। চিড়িয়াখানা বলেই মনে হয়। এটা মনে হচ্ছে সার্কাস। তারাওতো বাঘ, হাতি নিয়ে এক যায়গায় আসন গাড়ে, নানারকম খেলা দেখায়। এখানেও কি খেলা দেখা যাবে ?
চারিদিকে তাকালাম। বেশ কয়েকটি রিক্সা দাঁড়িয়ে। যার যেভাবে খুশী। তবে বেশীরভাগই দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ। ছোট ছেলেমেয়ে খুব একটা দেখলাম না, বাদামবিক্রেতা এবং হাতপাতাগুলি ছাড়া। হয়ত সবারই দেখা হয়ে গেছে, আমার মত যারা বয়স্ক, অথবা তরুনতরুনী তাদেরই হয়ত দেখা হয়ে ওঠেনি। আর আছে ঢাকায় নবাগতরা। তা পোষাক আষাক দেখেই তাদের চেনা যায়। আমি ওদের দলে নই। ওদের গায়ে এখনো ঢাকার গন্ধ লাগেনি। ঢাকায় আসলে প্রথমেই ঢাকার গন্ধ মাখতে হয়। একজন ভিক্ষুককেও রেগে আরেকজনকে বলতে শুনেছি, ‘কদিন হল এসেছিস? আমি দশ বছর ধরে ঢাকায় ভিক্ষে করি।’
একযায়গায় দেখলাম লম্বা লাইন। বুঝলাম ভেতরে ঢুকতে হলে ওই লাইনে আগে দাঁড়াতে হবে, টিকিট কিনতে হবে। দাঁড়ালাম এবং একসময় ছোট্ট কাগজের টিকিটও হাতে পেলাম। আশেপাশে বাদাম-লজেন্স-মোয়া বিক্রেতাদের দিকে ভ্রুক্ষেপও করলাম না। একটি রোগা পটকা ছেলে যেন বলল ভেতরে যাওয়ার টিকিট। এটা আবার কোন ধরনের আবদার। ভেতরে ঢুকে কাজ নেই। বাইরেই থাক। লোকজন কত দুরদুরান- থেকে এসেছে একটু বিনোদনের জন্য, সেখানে যেয়ে তাদের বিরক্ত করার দরকারটা কি ? বাইরেই ভাল আছিস। অন্তত আছিস তো এক যায়গায়। আর পারিশ তো কোন ফুটোফাটা দিয়ে ঢুকে পর ভেতরে, আমাকে জ্বালাতন করিশ কেন বাবা।
আমি ঢুকে পরলাম। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি কয়েকটা পেয়ারা গাছ। সোজা এগিয়ে গেলাম। বেশ ভীড় দেখতে পাচ্ছি এক যায়গায়। আমিও ভিড়ে মিশে গেলাম। মোটা মোটা লোহা দিয়ে ঘেরা যায়গা। বেশ দুরে একটা বাঘ বসে রয়েছে। হ্যাঁ, বাঘই তো। বসে না, শুয়ে রয়েছে। মনে হল ওঠার শক্তি নেই। এভাবে শুয়ে থাকা বাঘ কেউ টাকা দিয়ে টিকিট করে দেখে? দুএকজন খোঁচাখুচি করে তাকে জাগানোর চেষ্টা করল, কাজ হল না। আশা নেই দেখে সময় নষ্ট না করে সামনে এগোলাম।
দেখি আরেকটি খাঁচা। সেখানেও বাঘ। এর অবস্থাও তথৈবচ। বোটকা গন্ধ ছড়াচ্ছে। বাঁদিকে তাকিয়ে দেখি কয়েকটা হরিন হেঁটে বেড়াচ্ছে। যাহোক, নড়াচড়া তো করছে। কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে তাদেরই হাঁটাচলা দেখলাম।
বাঁদরের খাঁচা কোথায় ? ওটাই তো আসল দেখার যায়গা। আমাদের পুর্বপুরুষ কেমন ছিলেন না দেখলে, তাদেরকে একটু না খোঁচালে কেমন হয়। আমাদের এত দুঃখকষ্টের জন্য তারাই দায়ী। কে বলেছিল তাদেরকে লেজ খসিয়ে জামাকাপড় ধারন করতে। গাছের ডালে থাকলে দিব্বি ফলমুল খেয়ে কাটানো যেত, আর বাঘ হরিন দেখার জন্য টাকা খরচ করে টিকিট কিনতে হত না। দিব্যি দেখা যেত, যখন তখন।
কিন্তু বাঁনরের খাঁচা আমি খুঁজে পেলাম না। একজনকে জিজ্ঞেস করায় এমনভাবে তাকালেন যেন আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজে কোথায় জিজ্ঞেস করছি। কি আর করা। রাগ করে বেরিয়ে গেলেও যেতে পারি, কিন্তু টাকা খরচ করে ঢুকেছি, কিছুটা সময় না কাটালে টাকা উসুল হয় কিভাবে। তখনই দেখলাম ভিড়, তারপর বানরের খাচা। আমিও যোগ দিলাম ভিড়ে।
সত্যিকারের ভিড়টা এখানেই। যে যেভাবে পারে মুখ ভ্যাঙচাচ্ছে, অঙ্গভঙ্গি করছে। একটা বাচ্চা বানর সেটা দেখার জন্য খাচা ধরে ঝুলে আছে। পেছন থেকে সম্ভবত তার মা তাকে নামানোর চেষ্টা করছে কিন্তু কাজ হচ্ছে না। আমি যেন শুনতে পেলাম তার বক্তব্য, ‘মা দ্যাহ, দ্যাহ। কেমুন চিড়িয়া আইছে।’
তাড়াতাড়ি সরে গেলাম সেখান থেকে। এবারে যেদিকটায় ভীড় কম সেদিকে হাঁটতে শুরু করলাম। লেক না পুকুর কি বলব জানি না, তার ধার দিয়ে হেঁটে সবুজ ঘাঁসে ঢাকা একটা যায়গায় পৌছে গেলাম। বাহ্, বেশ যায়গা। সামনের সব দৃশ্য দেখা যায়। খাঁচার ভেতরের এবং বাইরের, সবই। সেখানেই বসে পরলাম।
আমার কপালে আসলে সুখ নেই। একটু পরই একজন যুবক এসে চটপটি খাওয়ার নিমন্ত্রন জানাল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম সেখানে রঙচঙে টিন দিয়ে বানানো একটি ঘর। বুঝলাম তার মতলব। চটপটি নামের বস্তুটি খেয়ে পকেটের টাকা তার পকেটে পাঠানো প্রয়োজন। আমি হাসিমুখে জানালাম যে আমার ও বস্তু খাওয়ার কোন আগ্রহ নেই। যুবকটি দেখলাম ভদ্রতার ধার ধারে না। রাগতভাবে বলল, ‘তাইলে এইহানে বসছেন ক্যান ?’
আমি চারিদিকে একবার ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম। এ যায়গাটির মালিকানা তাদের বলে মনে হল না। আর আমি তো ভেতরে ঢোকার জন্য রীতিমত টিকিট কেটেছি, কাজেই এখানে বসার অধিকার আমার আছে। আলবৎ আছে। আমি তাকে সেটা বলার জন্য মুখ খুললাম। সাথে সাথেই থামতে হল আমাকে। আরেকজন, আমার পাশেই বসেছিলেন, বললেন, ‘খান না, অসুবিধে কি? না খেলেও টাকা দিতে হবে। ওরা অনেক টাকা দিয়ে এ যায়গায় দোকান দিয়েছে।’
বুঝলাম তিনি ভুক্তভোগী। তার পাশেই রয়েছে একটি ছোট প্লেট। এখানে বসার মাশুল হিসেবে তাকেও গলাধরন করতে হয়েছে স্বে বস্তু। তিনি নিষয়টি আরো স্পষ্ট করে দিলেন, ’একজোড়া ছেলেমেয়ে তেহাড়ি খেয়ে আটশ টাকা বিল দিয়েছে।’
এরপর যা ঘটল তার বিররন দেয়া কষ্টকর। তিনদিনের নাকি তিন সপ্তাহের, নাকি তিনমাসের পুরনো কিছু দ্রব্য এনে হাজির করা হল আমার সামনে। একবার ভাবলাম সামনের পানিতে সেগুলি ফেলে দেই। আবার মনে হল এখানে অনেক বিরল প্রানী রয়েছে। বহু টাকায় আমদানী করা। কুমির, নাকি জলহস্তি। জলহস্তি হলে তো সুদুর আফ্রিকা থেকে আনা। এগুলি জাতিয় সম্পদ। আমার দোষে তাদের যদি ক্ষতি হয়, যদি অক্কা পায়, নিদেন পক্ষে ডায়রিয়া হয়। আমি প্লেটটি সেখানেই রেখে দাম দিয়ে উঠে পরলাম এবং টিকিটের টাকা উসুল না করেই বাইরে এসে পরলাম। বোটানিক্যাল গার্ডেনের দিকে একবার তাকানোর ইচ্ছেও হল না।