রসিক আলীর সাথে আমার পরিচয় হঠাৎ করেই। যদিও হঠাৎ করে শব্দটা আমি যুক্তিসংগত মনে করি না। জগতে যাকিছু ঘটেছে, যাকিছু ঘটছে তা হঠাৎ করেই ঘটে। নিউটন মাধ্যাকর্ষন সুত্র আবিস্কার করেছিলেন হঠাৎ করেই, আর আমার বাড়িঅলা গ্যারেজকে পাচতলা করে প্রতিতলায় একঘর বাড়িয়ে ভাড়া বাড়ানোর বুদ্ধি পেয়েছেন হঠাৎ করেই। হঠাৎ কথাটা না বললেও চলে।
বলছিলাম রসিক আলীর সাথে পরিচয়ের কথা। ব্যাপারটা আর কিছুই না, সবসময় যা ঘটে থাকে আরকি, রাস্তায় দাড়িয়ে তামাশা দেখছিলাম। এক চলন্ত রিক্সা আরেক থেমে থাকা রিক্সাকে ধাক্কা দিয়েছে। এই নিয়ে জটলা। চারিদিকে গাড়ি-রিক্সার মিছিল জমে গেছে, মানুষের সমাবেশ হয়েছে তারই মধ্যে দুজন গলা ফাটাচ্ছে। কেউ নিজে দায়ী নয়। যে রিক্সা রেখেছে তার ওখানে রিক্সা রাখা অধিকার, যে ধাক্কা মেরেছে তার ওদিক দিয়ে যাওয়া অধিকার। অগ্রাধিকারের হিসেব হবে পরে। না হওয়া পর্যন্ত হার মানবে কেন ? হারজিতের সিদ্ধান্ত হবে গলার জোর পরীক্ষা করে। যদি তাতেও কাজ না হয় তবে সমাধান হাতে হাতে। মনে হয় বিষয়টা সেদিকেই যাচ্ছিল। ঠিক আগের পর্ব। একজন বলল, ‘হাত-পা গোল কইরা দিমু। চিনসছ আমারে-'
আরেকজন বলল, 'ঠেংড়ি হাতে ধরায়া দিমু-'
অনেকেই দাড়িয়ে গেছে বিনে পয়সার সার্কাস দেখতে। দেশ থেকে সত্যিকারের সার্কাস উঠে গেছে বহু আগে। এমন মজা হয় না। এরই মাঝে কাণে এল, ‘হ্যায় প্রধানমন্ত্রী হইলে কি করত কইতে পারেন ?’
ঘুরে দেখলাম আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেছে। রোগা পাতলা গড়ন। হাইটে আমার চেয়েও কম। পোষাক আষাক সাধারন। সার্ট-প্যান্ট নিশ্চয়ই ফার্মগেট নয়ত ঢাকা কলেজের সামনে ফুটপাত থেকে কেনা। পায়ের স্যান্ডেল জোড়াও তাই। তবে অল্প সময়ের দেখাতেই যা তার দৃষ্টি। সরল-সোজা বোধহয় একেই বলে। আমি নিশ্চিত ধান্দাবাজির ফিকির করছে না। প্রতিমুহুর্তে এবিষয়ে শতর্ক থাকতে হয়। গায়ের চামড়া পর্যন্ত এলার্ট হয়ে গেছে।
ভাবলাম এড়িয়ে যাই। তারপরও কি মনে করে বললাম, ‘আপনিই বলুন।’
‘পুলিশ-বিডিআর-আর্মি দিয়া সব রিক্সাআলা মাইরা ফালাইত। তারপর রাস্তার ঠিক মাঝখান দিয়া একা রিক্সা চালাইত।’
আমি হাসি রাখতে পারলাম না। বললাম, ‘প্রধানমন্ত্রী হলে পৃথিবীর সবচেয়ে দামী গাড়িতে চড়বে, তার গাড়ির আগে-পিছে ডজন খানেক গাড়ি চলবে। আধঘন্টা আগে দুপাশের রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী হয়ে রিক্সা চালাবে কেন ?’
‘চালাইব-চালাইব। একবারের জন্য হইলেও চালাইব। রাইতের আন্ধারে হইলেও চালাইব। শখ মিটাইয়া চালাইব। শখ কহনো যায় না। এক জিনিষের শখ কি অন্য জিনিষ দিয়া মেটে ?’
তার কথার ধার কোনদিকে মাথায় এল না। তবে সে যে একেবারে বোকা না তা বোঝা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে বিষয়কে রসালো করে প্রকাশ করতে জানে। মনে মনে নাম দিয়ে ফেললাম রসিক আলী।
এভাবেই পরিচয়।
সামনের তামাসা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। রসিক আলী নিজেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। বলল, ‘চলেন চা খাই।’
মনেমনে ভাবলাম, ধান্দাবাজি মন্দ না। এই আক্রার বাজারে (ঘানার আক্রা না, দামের আক্রা) চা। সাথে হয়ত সিগারেট। তারপর যদি বিলটা আমার ওপর চাপিয়ে দেয় ?
ঘুরিয়ে বললাম, ‘একটু আগেই চা খেয়েছি। আপনি খান।’
‘আরে চলেন না। এককাপ চা-ই তো খাওয়ামু। এরবেশি আর কি খাওয়াইতে পারি। চলেন চলেন।’
রীতিমত আমাকে টেনেই নিয়ে চললেন।
ভীড়ের মধ্যে একা যাওয়াই কষ্টকর। তার ওপর যদি সঙ্গি থাকে, যদি চা খাওয়ানোর লোক হারানোর সম্ভাবনা থাকে তাহলে আরো সাবধান হতে হয়। গাড়ি-রিক্সা-মানুষ-গর্ত-ময়লা-ইয়ে সবকিছু এড়িয়ে কোনমতে এগিয়ে চললাম। রসিক আলীও খুব সাবধানে সেই কাজটিই করল। কোনমতে একটু ফাকায় এসে স্বস্তিতে হাটার সুযোগ পেলাম।
রসিক আলী বলল, ‘আমাদের দেশে ভাল ফুটবলার হয় না ক্যান কইতে পারেন ?’
‘হঠাৎ ফুটবল এল কেন ?’
‘না, মানে কইতেছিলাম রাস্তায় হাটতে গেলে যেমন কেউরি কাটতে হয় তার একটু খানি যদি মাঠে দেখান যায় তাইলে নির্ঘাত বিশ্বকাপ। এইডা হয়না ক্যান ?’
আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘হয়ত শারীরিক কারনে। সবাই তাই বলে। আমাদের শারীরিক সামর্থ কম। ইউরোপীয়ান-আফ্রিকানরা অনেক লম্বা। শক্তি বেশি।’
‘ম্যারাডোনার হাইট কত কইতে পারেন ?’
‘না-তো।’
‘আমার চেয়ে এক ইঞ্চি কম। লম্বা হইলে যদি ভাল ফুটবলার হইত তাইলে তার হাইট হওন দরকার ছিল দশ ফুট। ম্যারাডোনা, পেলে, রুনি, রোনাল্ডো-’
যুক্তিটা খারাপ না। ভাবলাম জিজ্ঞেস করি তার মতে কারণটা কি। কিন্তু সুযোগ পেলাম না। ততক্ষনে চায়ের দোকানে এসে গেছি। রসিক আলী চায়ের অর্ডারও দিয়ে ফেলেছে।
‘ওই লোকগুলান ওইখানে অমনে খাড়াইছে ক্যান কইতে পারেন ?’
দেখলাম দোকানদার যেখানে বসে চা বানাচ্ছে তার সামনে দাড়ানো ক্রেতার কথা বলছে। সেখানে পাচজন, না সাতজন দাড়িয়ে। এমনভাবে ঘিরে রয়েছে যেন অবরোধ। কাউকে দোকানদারের কাছে যেতে দেবে না। কেউ চা খাচ্ছে, কেউ সিগারেট, কেউ তাদের সঙ্গি। দাড়িয়ে গল্পগুজব করছে। একজন সিগারেট ধরানোর লাইটার হাতে নিয়ে গল্প চালিয়ে যাচ্ছে, আরেকজন সেই লাইটারের আশায় বক্তার কথার সাথেসাথে মুখের সিগারেটের নাচানাচি দেখছে।
‘আপনিই বলুন।’
‘শিখতাছে।’
‘বলেন কি! কি শিখছে ?’
‘শিখতাছে ক্যামনে কেটলিটা ধরে, কেমনে পাত্তি ঢালে, কতখানি দুধ দেয়, চিনি দেয়, কেমনে ঘুটা দেয়, কাষ্টমার কি কয়, তার উত্তরে কি কইতে হয় এইসব। কখন কোনডা কামে লাগে কওন তো যায় না। সবকিছু জানা ভাল।’
মনেহল কথাটা যুক্তিসংগত। আমি নিজেও বহুবার মনে করেছি এমন কৌতুহলী জাতি শুধু এই গ্রহে কেন মহাবিশ্বে খুজে পাওয়া যাবে না। নিজের জ্ঞানের কথা জানাতে যাচ্ছিলাম এরই মধ্যে একজন ধাক্কা দিয়ে রসিক আলীকে ঘুরিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমি বললাম, ‘সাইডে দাড়ান।’
রসিক আলী বলল, ‘সব সাইডই সাইড। যেদিকেই দাড়ান একজনের মনে হইব তার ওই দিক দিয়াই যাওন দরকার। যায়গা কতখানি খালি আছে তাতে যায়-আসে না। অহন আমি সাইড দেই না। মাঝখানে দাড়াই, দরকার হইলে ধাক্কা দিয়া যাই।’
‘আপনার চেয়ে শক্তি বেশি হলে ?’
‘তারও টেকনিক আছে। একদিনে এতকিছু মনে রাখতে পারবেন না। এইযে চা-ডা খান। এইডা আমার পারমানেন্ট চায়ের দোকান। ইসপেশাল চা।’
0 comments:
Post a Comment