মুখরোচক

May 15, 2009

আইনের মারপ্যাচ শব্দটির সাথে পরিচয় নেই এমন কাউকে খুজে পাওয়া কি সম্ভব ?

চোখ বন্ধ করে বলা যায়, সম্ভব না। একজন অপরাধী কোন আইনে কোথায় ফাক আছে জেনে অপরাধ করে না। সে অপরাধ করে, তারপর টাকা হাতে যায় সেইসব বিশেষজ্ঞের কাছে যারা জানে কিভাবে কোণ ফাক কোথায় থেকে বের করা যায়। ফাক যত ছোট, বেরনো যত কষ্টকর, টাকা তত বেশি।

যৌন হয়রানি রোধে নীতিমালা তৈরী করে দিয়েছে হাইকোর্ট। নতুন আইন তৈরী না হওয়া পর্যন্ত সরকারী-বেসরকারী সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেটা মানা বাধ্যতামুলক। অত্যন্ত প্রশংসার কাজ সন্দেহ নেই। যেখানে প্রতিদিন, প্রতিমুহুর্তে হয়রানির শিকার হচ্ছেন মহিলারা, বিশ্ববিদ্যালয়ের মত যায়গায় শিক্ষকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে কাজ হচ্ছে না, সেখানে এমন আইনই প্রয়োজন ছিল। কিন্তু-

কথা থেকে যায়। আরো বিস্তারিত নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এতে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল এইসব স্থানই শুধু নয়, রাস্তাঘাটও এর আওতায় আসবে। কারন সেখানে প্রতিনিয়ত মেয়েদের বিরক্ত করা, কটুক্তি করা থেকে শুরু করে শারীরিক লাচ্ছনার ঘটনা ঘটছে। কাজেই কোন মেয়ের দিকে খারাপ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকাও অপরাধ। কেউ সেটা করলে শাস্তি পেতে হবে।

আর, আইন কারো প্রতি অবিচার করতে পারে না। অপরাধ প্রমান না হওয়া পর্যন্ত অভিযুক্ত এবং অভিযোগকারীর পরিচয় গোপন রাখতে হবে।

সত্যিই মহান আইন। এই আইনের বলে যেসব জন্মপরিচয়হীণ রাস্তার পাশে সারাদিন দাড়িয়ে মেয়েদের বিরক্ত করার জন্যই আড্ডা দেয় তাদের শাস্তি দেয়া হবে, সেটা বন্ধ করা হবে।

বাস্তবে কি ঘটতে পারে একটু কল্পনা করা যাক। চোখে দেখা ছোট আকারের ঘটনার উল্লেখ করি। গার্মেন্টস ছুটির পর কয়েকজন মেয়ে হেটে বাড়ি ফিরছে গল্প করতে করতে। পথের পাশে দাড়ানো একজন পুলিশ। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সে হঠাৎ করেই একজনের মাথার পেছনে চাটি মারল। মেয়েটি ঘুরে দাড়াল। চোখ গরম করল। তারপর কোন প্রতিকার নেই দেখে ঘুরে চলে গেল।

এর বিচার কিভাবে হবে ? এই আইন দিয়ে ?????

কোন কাল্পনিক জগতে আপনারা বাস করছেন ? আপনাদের কোন আইনই প্রয়োজন নেই কারন আপনারা নিজেরা সুরক্ষিত। রাস্তায় যাওয়ার সময় আপনাদের গাড়ির কাচ লাগানো থাকে, পথের ধুলাবালি থেকে শুরু করে শব্দ পর্যন্ত সেখানে পৌছে না। কোন দৈবদৃষ্টিতে আপনারা জানলেন হয়রানীর ধরন। কিভাবে ঠিক করলেন তার প্রতিকার। সেই মেয়েটি নিজের পরিচয় গোপন রেখে অভিযোগ করবে কার কাছে ? সেই পুলিশের পরিচয় গোপন রেখে তদন্ত করবে কোন পুলিশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা যেখানে দিনের পর দিন আন্দোলন করে কারো গায়ে আচড় লাগাতে পারে না, তাদের বহিস্কার করা হয় আর দোষীকে বিনাবাক্যব্যয়ে বরন করা হয়, সংসদ ভবন যখন পতিতার আখড়া সেখানে পথেঘাটে তারা হয়রানি বন্ধ করবেন এক আইনের ঘোষনা দিয়ে। বলিহারি।

কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরুন। এ সমাজে হাতেগোনা কজন এজন্য দায়ি না। দায়ি অধিকাংশ মানুষ। কেউ প্রত্যক্ষভাবে, কেউ পরোক্ষভাবে। নারীদের সন্মান করতে হয় একথা কোন অভিভাবক শেখায় না, কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শেখায় না। রাজপথে যখন কারো সম্পর্কে কটু মন্তব্য করা হয় তখন আশেপাশের মানুষ সেটা উপভোগ করে। নয়ত নিজের চামড়া বাচাতে মাথা নিচু করে সরে যায়। আইন দিয়ে, পুলিশ দিয়ে সেটা বন্ধ করা যায় না। আর পুলিশ - তাদের কথা নতুন করে আর বলার প্রয়োজন নেই। শুধূ এটুকু বলতে পারি, আমেরিকায় দুচারটা খুন করেও পার পেতে পারেন, পুলিশ খুন করলে নিশ্চিত মৃত্যু। আর আমেরিকার পুলিশ ঘুস নিয়েছে একথা লাদেনপুত্রও বলবে না।

যারা এই আইন তৈরীর জন্য বহু বছর ধরে চেষ্টা করেছেন তাদের প্রশংসা করার ভাষা নেই। যুগ যুগ ধরে চেষ্টা করার পর তারা অন্তত এটুকু আদায় করতে পেরেছেন। কিন্তু আপনাদের কাজ শেষ হয়নি। মাত্র শুরু। আপনাদের হাতে অস্ত্র ছিল না, এখন রয়েছে। কাজে লাগিয়ে দেখুন সেই অস্ত্রের ধার কতটা, তাতে কি কাটা যায়। আদৌ কিছু কাটা যায় কি না। খুব দ্রুত কিছু ঘটনা সামনে আনুন, কিছু অপরাধীকে শাস্তি দিন, সংবাদ মাধ্যমে জানান সেই সুখবর। সবাইকে জানিয়ে দিন কাউকে হয়রানি করা, যে কোনভাবেই করা হোক, সেটা অপরাধ। সেই অপরাধে শাস্তি হয়।

আরো একটা কথা না বললে চলে না। নারীদের উত্তক্ত করাকে আপনারা শাস্তি দেবেন সেটা যুক্তিসংগত। কিন্ত যারা বের হন উত্তক্ত হওয়ার জন্য সেদিকে কি দৃষ্টি দেবেন। ঠিক কিভাবে, কোন পোষাকে, শরীরের কোন অংশ অন্যদের সামনে তুলে ধরা যাবে, কোন ভংগিতে হাটতে হবে এসব নিখুত হিসেব করে যারা পথে বের হন, যেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রণিক মিডিয়া ইউরোপ-আমেরিকা থেকে সংগ্রহ করে সেই বিশেষ তথ্যগুলি তাদের কাছে পৌছে দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছে তাদের সম্পর্কে কি কিছু বলবেন ? এদেশ হঠাৎ করে ইউরোপ-আমেরিকা হয়ে যায়নি যে উঠতি বয়সি একজন তরুনীকে বুকে টাট্টু একে তারসাথে মানানসই পোষাক পড়ে সেটা প্রদর্শন করতে হবে, হাফপ্যান্ট পড়ে মোটর সাইকেলের পিছনে বসে সিগারেট টানাকে বাহাদুরী মনে করতে হবে আর একজন যুবকের সৌন্দর্য্য বাড়ানোর জন্য হাতে একগোছা চুড়ি পড়তে হবে, বেকহ্যাম ষ্টাইলে কানে সাদা প্লাষ্টিক লাগাতে হবে, শরীর থেকে নামিয়ে শুধু পা ঢাকার জন্য প্যান্ট পড়তে হবে। এদের লক্ষই থাকে কিভাবে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষন করা যায়। যার যা সম্পদ সে তাই দেখায়। মেধার এবং যোগ্যতার সৌন্দর্য্য যখন অনুপস্থিত তখন সে যায়গা দখল করেছে শরীর, পোষাক, আচরণ, ভাষা। এদের এইসব কর্মকান্ডের ফল ভোগ করতে হয় যারা প্রয়োজনে ঘরের বাইরে আসেন তাদের। সত্যিকারের সমস্যাকে আড়াল করবেন না।

একটা জাতি যখন অবক্ষয়ের মধ্যে বাস করে সেখানে আইন প্রয়োজন তবে সমাধান শুধুমাত্র আইনে নেই। প্রয়োজন সচেতনতা এবং শিক্ষা। মন্দের চেয়ে ভালকে সামনে আসার সুযোগ করে দেয়া। সব যায়গায় সুশিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। যদি সেটা না করা হয় তাহলে এই আইন মুখরোচক আইন হিসেবে বিবেচিত হবে। আচার-চাটনি খেতে ভালই লাগে তারপরও ভাত-রুটি প্রয়োজন হয়। সেকথা ভুলে যাবেন না।

0 comments:

 

Browse