মাইরের উপরে ওষুধ নাই

Jun 28, 2009

দৃশ্যটি আমাকে প্রতিদিন দেখতে হয় মোড়ের ওপর ডজন ডজন রিক্সা এসে দাড়াচ্ছে আর তিনচারজন ট্রাফিক পুলিশ সেগুলি সরানোর জন্য ঠেলাঠেলি করছে ধাক্কা মেরে একটা রিক্সাকে হয়ত সরানো গেল সাথেসাথে আরো দুজন এসে হাজির নানারকম চেষ্টা কসরত চলে রিক্সা সরানোর হাতে লাঠি থাকলে রিক্সার ওপর ঠকাস ঠকাস বাড়ি, পাম্প ছেড়ে দেয়ার ভয় দেখানো, কখনো কখনো ছেড়ে দেয়া, কখনো রিক্সার সিট খুলে একপাশে রেখে দেয়া, সবকিছুই কিন্তু ফল একই ঠিক মোড়ের ওপর থেকে রিক্সার ভীড় কমে না এর প্রভাব ছড়িয়ে যায় রাস্তায় চলা গাড়ি, ট্যাক্সি থেকে শুরু করে হেটেচলা মানুষ সবখানে সবাই কোনমতে থেমে, ধাক্কা খেয়ে, একেবেকে চলে

একসময় ট্রাফিক পুলিশের অনেক দুর্নামের কথা শোনা যেত তারা রিক্সাচালকদের কাছে ঘুষ নেয়, না পেলে দুর্ব্যাবহার করে কোন অদৃশ্য যাদুবলে সেটা বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে এমন সাফলের উদাহরন সম্ভবত দেশে আর একটিও নেই তারা ঘুষ নেয় না, মারা তো দুরের কথা ধমক দেয়া, গালাগালিও করে না গায়ের ওপর রিক্সা উঠিয়ে দিলেও না পুরো ঢাকা শহর জুড়ে ট্রাফিক পুলিশ দৃষ্টান্তযোগ্য ধৈর্য্য লাভ করেছে প্রচন্ড রোদে, বৃষ্টির মধ্যে সারাদিন দাড়িয়ে ভিড়-ঠেলাঠেলি সামলানোর পরও সামান্যতম বিরক্তি দেখা যায় না কাজে গাফিলতি নেই

আমি অবশ্য ট্রাফিক পুলিশের কথাই বলছি মোটরসাইকেল নিয়ে যেসব ষাড়-জেন্ট তাদের হিসেব কিছুটা অন্যরকম তারা আরো অনেক বেশি দায়িত্বশীল হলেও এত কঠোর পরিশ্রম করতে হয় না তাদের দায়িত্ববোধের প্রশংসাই শুধু করতে হয়। মোড়ের একপাশে মোটরসাইকেল থামিয়ে তার ওপর বসে নজরদারী করেন কোন গাড়িতে ভুয়া কাগজ, কোন গাড়িতে অতিরিক্ত মাল, কোন গাড়িতে অবৈধ মাল কোনটি তাদের দৃষ্টি এড়ায় না সাথেসাথে ইসারা করেন গাড়ি থাকে ড্রাইভার অথবা অধীনস্থ পুলিশের মাধ্যমে কাগজ এসে পৌছে তার হাতে তারপর সেটা ফেরত যায় গাড়ি চলে যায় তার পকেট ফুলে ওঠে তিনি নতুন গাড়ির সন্ধান করেন পকেটের রেডিওতে যদি বেজে ওঠে কোন ভিআইপি আসবেন সাথেসাথে তারা লাফিয়ে ওঠেন। সব অলিগলি বন্ধ, রাস্তা ফাকা। ভিআইপি যেন তীরবেগে যেতে পারেন সে ব্যবস্থা হয়ে যায়। দায়িত্ব পালনে তারা এতটাই দায়িত্বশীল যে কাজ শেষে বাড়িতে গিয়ে বিশ্রামের কথাও ভাবেন না আবারও মোটরসাইকেল নিয়ে হাজির হন পথের মোড়ে কয়েকজন একসাথে মোটরসাইকেল থামিয়ে বসে সেখানেই আড্ডা গাড়েন এবং রাস্তার দিকে চোখ রাখেন এবং বিনা টাকায় ওভারটাইম ডিউটি করেন

বলছিলাম আমার দেখা নিত্যদিনের রিক্সা ঠেলার কথা হঠাৎ করেই একদিন দেখলাম ব্যতিক্রম ঠেলাঠেলির যায়গাটা একেবারে ফাকা মানুষজন ধাক্কাধাক্কি না করেই হাটছে রাস্তার গাড়িগুলো আটকে নেই।

কারন কি এ অসাধ্যসাধন হল কিভাবে ?

পরমুহুর্তেই কারনটা দৃষ্টিগোচর হল একজন রিক্সাচালক, সম্ভবত আত্মবিশ্বাস অন্যদের থেকে বেশি, এসে দাড়াল তখনই দেখলাম তাকে একনজরই বলে দেয় নতুন ঢুকেছে পুলিশে গ্রাম্য চেহারা ছেড়ে এখনো শহুরে হয়নি সে অপেক্ষা করছে চুপচাপ রিক্সাচালক এসে সবে আরাম করে বসার উদ্দ্যোগ নিয়েছে, লাঠিটা গিয়ে পড়ল তার ওপর রিক্সাচালক রেগে ঘুরে দাড়াল মুখ খুলতে যাবে, তখনই আরেকবার মুখ খুলে কিছু বলল, সাথেসাথে আরেকবার আবারও লাঠি উচু হয়েছে সেটা নামার আগেই সে রনেভঙ্গ দিল যায়গাটা খালি হয়ে গেল অন্যরা দুরে থেকে হাসাহাসি করছে

রিক্সা সরালে গাড়ি-ট্যক্সিঅলারা ধরেই নেয় তাদের কারনেই এগুলি করা হয়েছে তাদের গাড়ি রাখতে সমস্যা হয়, এটা তারই সমাধান সম্ভবত সেকথা মনে করেই একজন ট্যাক্সীচালক রীতিমত চ্যাগাইয়া বসার মত গাড়ি রেখে তাতে হেলান দিয়ে হাওয়া খাচ্ছিল একজন ভদ্রমহিলা এসে জিজ্ঞেস করল, যাবেন ?

সে ভদ্রমহিলাকে একবার আপাদমস্তক দেখল কোন উত্তর দেয়াও প্রয়োজন করে করল না তখনই ঘটল ঘটনা

সে মাত্র মুখ ঘুরিয়েছে আমার পাশেই দাড়িয়েছিল এক যুবক সে গিয়ে তার কলারটা চেপে ধরল কিছু বুঝে ওঠার আগেই, টাল সামলানোর আগেই ধাক্কা খেল নিজের গাড়ির সাথে কোনমতে সামলে হয়ত কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু যুবকটি, সেই ট্রাফিক পুলিশের মতই কোন কথা না বলে আঙুল দেখাল ড্রাইভিং সিটের দিকে সে মুখ না খুলে সোজা সেখানে গিয়ে বসল আর যুবক নিজেই গাড়ির দরজা খুলে ভদ্রমহিলাকে ঢোকার যায়গা করে দিল ভদ্রমহিলা শসংকোচে উঠে বসলেন

আমি ভেবেছিলাম যুবক তার সঙ্গি কিন্তু সে ড্রাইভারের দিকে হাত নেড়ে রওনা হতে বলল তারপর এসে দাড়াল চায়ের দোকানে গাড়িটা চলে গেল।

আমার মনে পড়ল বহুদিন আগে একজনের দেয়া একটা ষ্টিকারের কথা মাইরের উপড়ে ওষুধ নাই দেখতে দেখতে চাক্ষুস প্রমান মিলল একে একে দুইবার

কথাটা ভাবতে ভাবতে চা খাচ্ছিলাম তখনই কানে এল, পোলাডা প্রধানমন্ত্রী হইলে কি করত কন তো ?

চমকে উঠে দেখলাম এ সেই রসিক আলী আরে আপনি ? এতদিন ছিলেন কোথায় ?

রসিক আলী সেকথার উত্তর না দিয়ে হাসল সে যে প্রশ্ন করেছিল সেটার কথাও ভুলে গেছে ততক্ষনে তাকে দেখার সাথেসাথে আরেকটা চা তৈরী হচ্ছে ঘুরে দেখলাম যুবকটি উধাও রসিক আলী সেই যুবকের কথা বলল না পুলিশের কথা বলল ধরতে পারলাম না

জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপার কি ? ব্যায়াম করছেন নাকি ?

রসিক আলী অবাক হল প্রশ্ন শুনে, ক্যামনে বুঝলেন কনতো ? মোটা হইছি ?

উল্টো তাকে প্রশ্ন করলাম, ব্যায়াম করলে কি মানুষ মোটা হয় ? তাহলে মোটারা ব্যায়াম করে কেন ?

রসিক আলীর অবাক ভাব যায়নি ব্যাখ্যা করে বলতে হল, পাতলা থেকে মোটাও হননি, মোটা থেকে ভুড়িও কমেনি আসলে আপনার নড়াচড়া দেখে বোঝা যাচ্ছে কেমন যেন একধরনের, সেই যাকে বলে ক্ষিপ্রতা চোখে পড়ছে

রসিক আলী আরো অবাক হয়ে বলল, কি চোখ রে বাবা দেইখাই বুইঝা ফালাইলেন ?

শান্তভাবে বললাম, বুঝতে হয় কারো সাথে গুতাগুতি লাগলে তার শক্তি কতখানি সেটা জানতে হয় এটা একজন শিখিয়েছে বলদ যত তাগড়াই হোক তারচেয়ে রোগা ষাড় ভয়ংকর

রসিক আলী বলল, ভাল কথা শিখাইলেন ওইযে পোলাডা তার প্রমান গায়েগতরে বড় না হইতে পারে কেমনে কাজ হইব জানে একাই সব কন্ট্রোল করতাছে

এতক্ষনে বুঝলাম পুলিশের কথা বলছে আমাকে বলতে হল, আর কদিন দুচারদিন গেলে শিখে নেবে কি করতে হয় আপনার বিষয়টা কি বলুন এতদিন দেখলাম না কেন ? আমি প্রতিদিন এখানে আসি আর মনেমনে আপনাকে খুজি

রসিক আলী বলল, আর কইয়েন না একটু সমস্যায় ছিলাম

চা তৈরী হওয়ায় কাপটা হাতে নিল রসিক আলী তখনই চোখে পড়ল তার হাতের দিকে সাথেসাথে মুখে আন্তরিকতা এনে জিজ্ঞেস করলাম, হাতে কি হয়েছে ?

রসিক আলী চায়ে চুমুক দিয়ে হাতটা একবার উল্টে দেখল তারপর বলল, এরই জন্য এতকিছু এইডারে কয় মাইরের উপড়ে ওষুধ নাই সেই ওষুধ দিতে গিয়া ব্যথা পাইছি আপনের সেই ব্যায়ামটাও শুরু করছি সেইদিন ঠিক করছি ডাক্তারি যহন করতেই হইব ভালভাবেই করমু

জিজ্ঞেস করলাম, আপনি আবার কার চিকিৎসা করলেন ?

রসিক আলী বলল, কয়দিন আগের একটা ঘটনা রাস্তা দিয়া যাইতাছি দেখি একটা স্কুলের পোলা হাইটা আসতাছে কান্ধে ব্যাগ আনমনা মনে হয় কি জানি ভাবতাছে দেইখা নিজের ছোটবেলার কথা মনে হইল তখনই দেখি একটা গাড়ি পিছন থিক্যা ধাক্কা দিয়ে তারে ফালাইয়া দিল ফাকা রাস্তা, পোলাডা রাস্তায়ও ওঠে নাই, ধার দিয়া হাটতাছে, তারই মইধ্যে এই ঘটনা গাড়িডা থামাইলাম ড্রাইভাররে জিগাইলাম তুমি যে রাস্তায় গাড়ি নামাইছ, পরীক্ষা দিয়া লাইসেন্স পাইছ, এইগুলানের কোন দাম আছে ? একটু হইলে পোলাডা মারা যাইত ব্যাটায় আমার উপর উল্টা ঝাড়ি লয় কয় ঠিকই আছে সাবধানে হাটে না ক্যান তার ওপর আবার আরেক ব্যাটা, গাড়ির মালিক-টালিক কিছু হইব, গাড়ি থিক্যা নাইমা আমারে গালাগালি গাড়ি থামাইছি ক্যান পকেট থিক্যা ফোন বাইর করছে আমার কি করব আর সহ্য হইল না বুঝলেন দিলাম কয়ডা উল্টাপুল্টা ঘুসি রাস্তার কয়জন আইসা যোগ দিল গাড়ির কাচ ভাঙল তারপর সব ঠান্ডা এজন পুলিশ আগাইছিল, সেও অবস্থা দেইখা ভাগছে গাড়ির মালিক-ড্রাইভার হাতেপায়ে ধইরা মাফ চাইছে তহন মনে হইল এইডা হইল সত্যিকারের ডাক্তারী নিজে অন্যায় করমু না আরেকজনের অন্যায় সহ্য করমু না সেইজন্য ব্যায়াম কইরা চিকিৎসা শিখতাছি দেহেন না, আরো আগে প্রাকটিস শুরু করলে হাতের এই অবস্থা হইত না

জয় বাবা মাইর সত্যিই, মাইরের উপরে ওষুধ নাই

0 comments:

 

Browse