পর্যবেক্ষন মানে বিজ্ঞান

Jun 27, 2009

পর্যবেক্ষন মানে বিজ্ঞান তা কমবেশি সবাই জানি পরীক্ষা এবং পর্যক্ষেনের পর যে ফল পাওয়া যায় তাহাকে বিজ্ঞান বলা হয়, মুখস্ত করতে হয় স্কুলে আধুনিক বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটেছে নিউটন, গ্যালিলিও, আইনষ্টাইনের হাত ধরে সেটাও আমরা জানি কেউ কেউ বড়জোর লিওনার্দোর নাম এনে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলেন আমরা অনেকেই হয়ত জানি না যে অ্যালজেব্রা শব্দটি এসেছে আরবী শব্দ আল-জবর থেকে এর উৎপত্তি ইরাকের বসরায় আধুনিক অংকের শুরু হয়েছে সেখানে। নিউটনের কয়েকশ বছর আগে তিনি বর্ণালী নিয়ে প্রবন্ধ লিখে গেছেন এবং তিনিই বলে গেছেন বিজ্ঞান আসলে পর্যবেক্ষন শুধুমাত্র তাত্ত্বিক আলোচনা নয়

তবে আমার বক্তব্য এখানে না একেবারেই নিতান্ত প্রাত্যহিক পর্যবেক্ষন নিয়ে প্রাত্যহিক বিজ্ঞানও বলতে পারেন প্রতি মুহুর্তে আমরা যা চোখে দেখি, পর্যবেক্ষন করি, আমাদের মস্তিস্ক বিশ্লেষন করে এবং আমরা একটা সিদ্ধান্তে উপনিত হই, ফল পাই সেই বিজ্ঞান নিয়ে

একটা উদাহরন দিয়ে দেখা যাক

ধরুন আপনি হেটে যাচ্ছেন রাস্তা দিয়ে ফুটপাত বলে যে যায়গা থাকার কথা ছিল সেখানে চায়ের দোকান, পুরনো জামাকাপড়ের দোকান, চটপটি-পুরি-আলুর চপের দোকান, তারপর গাড়ি পার্কি, এক কিংবা দুই সারি তারপর মানুষের মিছিল এই সবকিছু হিসেব করে এগোচ্ছেন একটু সামনে চলন্ত গাড়ি আর পার্ক করা গাড়ির মাঝখানে যে ফাকা যায়গাটুকু রয়েছে সেটা তাক করে এগিয়ে যাচ্ছেন অনেকটা এগিয়ে গেছেন তখনই আতংকিত চোখে দেখলেন ওদিক দিয়ে আরেকটা দেহ ঢুকছে

যেপথে গরু চলে সেপথ থেকে সরে দাড়াতে হয় বপুটা দেখে আপনাকে বাধ্য হয়ে পিছিয়ে এসে দাড়াতে হল সেই বিশাল বপু পার হবেন তারপর আপনি সুযোগ পাবেন

তবে সবকিছু সেভাবে ঘটল না সেই বিশাল বপু মাঝপথে আসার পথ থামলেন একটু ঘুরলেন হাতটা পকেটে ঢুকালেন মোবাইল ফোন বের করলেন সেটা দেখলেন টিপলেন কানের কাছে ধরলেন কথা বলতে শুরু করলেন এবং কথা বলতেই থাকলেন

ততক্ষনে আপনার পিছনে দাড়িয়ে গেছে কয়েকজন ওদিকে আরো কজন এই অবস্থায় আপনার একটামাত্র কাজই করার থাকে পর্যবেক্ষন অন্য ভাষায়, বিজ্ঞানচর্চ্চা সেখানে দাড়িয়ে তাকে পর্যবেক্ষন করুন

প্রথমেই আপনার পর্যবেক্ষনের বস্তু তার দেহ ওটা অমন হল কিভাবে ? এদেশে নাকি অধিকাংশ মানুষ খেতে পায় না পেট ভরার জন্য খায় ভাত নয় রুটি আফ্রিকার মানুষের খাবারে নাকি পুষ্টিগুন এরচেয়ে বেশি। দেশের পরিচয় দেবার সময় বলা হয় সবচেয়ে দরিদ্র একটি দেশ।

পরমুহুর্তে এই অনর্থক প্রশ্ন বাতিল করে দিলেন চাইনিজ-থাই-ইতালিয়ান-ফ্রেঞ্জ সবধরনের ডিস পাওয়া যায় বহুদিন থেকে তারপর বার্গার-হটডগ-পিজ্জা রীতিমত সেকেলে। সরমা-গ্রীল-বটি-শিক এসব তো আছেই তারপর আছে কেফসি-পিজাহাট এমনটা হতেই পারে পথেঘাটে বিস্তর দেখা যায়

পোষাকটা একবার দেখলেন এতেও নতুনত্ব নেই যে কোন এসি মার্কেটে ঢুকলে এসব পাওয়া যায় গুলশান-বনানী-পান্থপথ-হাতিরপুল-ধানমন্ডি-সাইন্সল্যাব সবখানে আবার ফুটপাতেও পাওয়া যায় একই জিনিষ

পায়ের জুতা, হাতের চুড়ি, কোমড়ের বেল্ট এসব একনজর দেখে নিলেন এগুলির ক্ষেত্রেও একই কথা ফুটপাতে, রাতের মার্কেটে পাওয়া যায় আবার এসি মার্কেটেও পাওয়া যায় দেখে চেনার উপায় নেই

এরপর আপনার মনোযোগ গেল সত্যিকারের পর্যবেক্ষনের দিকে

উনি অন্যের পথ বন্ধ করে চির উন্নত মম শির করে কথা বলে চলেছেন কেন ? একটু সরে দাড়ালে আরো নির্বিঘ্নে কথা বলতে পারতেন, অন্যরাও বাধাগ্রস্থ হত না।

অন্যদের দেখাচ্ছেন, দেখ আমি কি করতে পারি ? সাধ্য আছে আমার সামনে যাবি ? দেখি কেমন বাপের ব্যাটা জানস আমি কেডা ? ফোনে কেডা আছে শুনবি ? শুনলে তর-

আপনার পর্যবেক্ষন আর এগোল না কারন কারো কারো এত পর্যবেক্ষনের ধৈর্য্য নেই তারা গুতোগুতি শুরু করেছে কথার তুবড়ি ছুটছে সেদিকটা একবার দেখলেন। প্রতিমুহুর্তে নতুন নতুন শব্দ যোগ হচ্ছে ভাষার ভান্ডারে। সেই শব্দের তোড়ে আপনার পর্যবেক্ষনের খেই হারিয়ে গেল।

বরং আরো নিরাপদ পর্যবেক্ষনের দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। মোটামুটি নিরাপদে দাড়ানো যায় এমন যায়গায় দাড়িয়ে। কোনমতে সে ব্যবস্থা করা গেল। আপনার পর্যবেক্ষনের বিষয়;

একজন পুলিশ চায়ের দোকানের কাছে এসে দাড়ালেন চারিদিকে দেখলেন তার সঙ্গি আরো দুজন, তারা কিছুটা দুরে। আপনার দৃষ্টি কাড়ল একজনই। তার দৃষ্টি, অঙ্গভঙ্গি পর্যবেক্ষন করে তার মনের ভাষা পড়ার চেষ্টা করতে থাকলেন।

এই ব্যাডা করে কি ? খাড়ায়া খাড়ায়া চা খাইত্যাছে। সাথে মনে হয় আর কেই নাই। একাই। আবার এইদিক-ওইদিক চায়। কারো অপেক্ষা করতাছে মনে হয়। জামাকাপড় কি গুলশান থিক্যা কেনা ? আইজকাল গুলশান আর ফুটপাতের পার্থক্য ধরা যায় না। পায়ের জুতাডাও ফুটপাতে পাওয়া যায়। চুল চেহারা দেইখাও চেনার উপায় নাই। চিনতে ভুল করলে মুসকিল।

শরীলে দামি কি আছে ? স্বাস্থ্যডা ভালই কিন্তু চকচক করতাছে না। ভাল খাইতে পাইলে চকচক করত। জুতাডাও ময়লা। কয়েক মাইল হাটছে। তারমানে গুলশান-বনানীর পোলা না। তারা এত হাটে না। পকেটে উচা হইয়া রইছে ওইডা কি ? মোবাইল ? দেইখ্যা বড় মনে হয়। আইজকাল বড়-ছোট দেইখা দামী-কমদামী বোঝা যায় না। চাইনিজ মাল সব।

দোকানে কয়টাকার নোট দ্যায় দেহি। অ, ট্যাকাপয়সা আছে দ্যাহা যায়। কি সিগারেট ধরায় ? সোনালী সিগারেট ? না-তো।

পাইছি। এইডা বড়লোকের পোলা হইতেই পারে না। হ্যারা কমদামী সিগারেট খায় না। থানার কথা কইয়া অর্ধেক রাস্তা নিলেই-

এই-যে !!!

পর্যবেক্ষন সব যায়গায় চলতে পারে। অফিসে, দোকানে, রাস্তায়, বাসে, সবখানে, সবসময়। আপনি দেখলে একজন তিনজন বসার মত সোফার মাঝখানে বসে রয়েছেন। যাকে বলে ঠ্যাং চ্যাগাইয়া, কনুই চ্যাগাইয়া বসা সেই ধরনে। আপনাকে স্পষ্ট বলে দিচ্ছে আপনি কোনদিকে বসার সুযোগ পাবেন না। মাঝখানে তো নয়ই, দুপাশে বসতে হলে কনুই ঠেলে বসতে হবে। সেইসাথে এটাও জানিয়ে দিচ্ছেন আপনাকে, আপনার দৌড় দেখান। আরো এলাইয়া বসমু, সইরা বসমু, না উইঠ্যা যামু।

আপনার পর্যবেক্ষনক্ষমতা এবং অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে আপনার প্রতিক্রিয়া।যদি পুরোপুরি ভদ্র মনে করেন দুর্গন্ধ এড়ানোর মত দুরে থাকবেন এবং তাকে আরো বসার সুযোগ করে দেবেন, যদি ভদ্রতার গন্ধ লেগে থাকে তাহলে তাকে সরে বসতে বলবেন এবং সেটাই আশা করবেন। আর যদি সত্যিকারের অভিজ্ঞ হন তাহলে অনিচ্ছায় একটা লাথি মেরে, কনুইয়ের গুতো দিয়ে বসে পড়বেন। ক্ষেত্র বিশেষে সবচেয়ে ভাল ফল পাওয়া যায় এতেই, কারন তিনিও পর্যবেক্ষনগুনে বুঝে যান যায়গা ছেড়ে দেয়াই উত্তম।

এই পর্যবেক্ষন চলতে পারে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। প্রাকটিস মেকস এ ম্যান পারফেক্ট। একসময় নিখুতভাবে বুঝে যাওয়া সম্ভব কার মনে কি চিন্তা চলছে। এরপর কি ঘটতে যাচ্ছে। কখন, কোথায়, কারসাথে কি আচরন করতে হবে।

তবে সবাই এত ধৈয্য নিয়ে দিনের পর দিন পর্যবেক্ষন চালায় না। সেকারনে অনেক সময় পর্যবেক্ষন সাধারন ঘটনা দর্শনে পরিনত হয়। এমনকি বিপদের সম্ভাবনাও তৈরী করে।

চায়ের দোকানের পাশে দাড়িয়ে সিগারেট টানছেন এক ভদ্রলোক একেবারেই রোগা দুবলা, সার্ট প্যান্ট ময়লা, পায়ে স্যান্ডেল চোখে উদাস দৃষ্টি পকেটের অবস্থা নিশ্চয়ই মাঝারী এক যুবক এগিয়ে গেল কাছে

আরে ভাই ক্যামুন আছেন ?

ভদ্রলোক একবার তাকিয়ে দেখলেন তার উদাস দৃষ্টি পাল্টাল না

আপনারে প্রায়ই দেহি ওই দিক দিয়া হাইটা যান রফিক ভাইরে চিনলেন ? ওই যে আমাগো বড় ভাই হগ্গলে হিরঞ্চি রফিক কয় আমাগো পাড়ার আর কি আপনারে তো চেনে

ভদ্রলোক আরেকবার দেখলেন বক্তাকে

সেদিন হইছে কি জানেন ঈদের আগে মতিন সাবে আইসা ট্যাকা দিয়া গ্যাছে কইছে ভাগ-বাটোয়ারা কইরা ল ঈদ কর আমারে দিছে মাত্র দুইশ বড় ভাই দেইখা কিছু কই নাই আমার আবার রাগ খুব বেশি কেউ আমার চোখের দিকে চাইয়া কথা কয় না ওইযে খবরে দ্যাখছেন না, তিনজন হাসপাতালে গ্যাছে এইডা হইল- আচ্ছা থাউক সেসব কথা আমারে পাচশ ট্যাকা দ্যান তো হাতটা খালি একটু মিরপুরের দিকে যামু আমার বইন হাসপাতালে রইছে-

ভদ্রলোক হাতের সিগারেটটা ফেলে দুহাত পকেটে ঢুকালেন

আপনারে আমি খুব মান্য করি আমি সবাইরে মান্য করি রফিক ভাই শিখাইছে বড়রে সন্মান কইরা কথা কইতে হয় আখেরে-

‌‌কথা শেষ হয়েছে ?

এবার যুবকের মুখে উত্তর শোনা গেল না সে অবাক হয়ে তাকাল

ভদ্রলোকের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত, ‌ভাগ

এতক্ষনে যুবকের বোধোদয় হল, তার পর্যবেক্ষনে ভূল ছিল

0 comments:

 

Browse