নিজের ঘরে এডভেঞ্চার

Jul 19, 2011
একজন মানুষ নিজের জীবন বাজি রেখে লড়াই করে যাচ্ছে এমন রোমাঞ্চকর দৃশ্য দেখতে খুবই ভাল লাগে। ড্রইংরুমে বসে দেখবেন ভুমিকম্প, ঘুর্নিঝড়, জলোচ্ছাস, আগ্নেয়গিরি কিংবা পারমানবিক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই। তারপর বলবেন, আহা কি চমতকার। এটাই তো মানবজাতির পরিচয়। এভাবেই তো আদিমানব জাহাজ-নৌকা ছাড়াই সাগরপাড়ি দিয়েছে, এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে গেছে, এক মেরু থেকে আরেক মেরুতে গেছে, এভারেষ্টের চুড়ায় উঠেছে।  আজও করছে। ওইতো মুসা-মুহিত এভারেষ্টের মাথায় উঠেছে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে।
ঘরে বসে হাই ডেফিনিশনে এসব দেখার মজাই আলাদা। খরচ তো বেশি না। ৫০ টাকা হলেই ডিভিডি কেনা যায়। টিভিটার দাম একটু বেশি এই যা। সাথে হোম থিয়েটার সাউন্ড। মনে হবে ঘটনার মধ্যেই বসে দেখছি। যারা এসব তৈরী করেন তারাও জানেন মানুষ কি পছন্দ করে। কোটি ডলার ব্যয় করে তৈরী করেন একেবারে পছন্দসই দৃশ্য।
গত অস্কারের সময় একটা ছবি এমনই আগ্রহ তৈরী হয়েছিল। একজন ব্যক্তির জীবনের সত্য ঘটনা নিয়ে তৈরী। সেই ব্যক্তি, যুবকই বলা যায়, পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতে ভালবাসেন। কোথায় যান সেটাও কাউকে জানিয়ে যান না। এতেই নাকি মজা। প্রকৃতির মধ্যে তিনি একা একজন।
সেবারও কাউকে না জানিয়ে গেছেন এক পাহাড়ে। তারপর পা পিছলে একেবারে খাদের মধ্যে। প্রানে মরেননি বটে কিন্তু তারচেয়ে বড় সমস্যায় পড়েছেন। বড় একটা পাথরের নিচে চাপা পড়েছে ডানহাত। চেষ্টা করলেন সেটা টেনে ছাড়াতে কিন্তু কাজ হল না।
এভাবে কেটে গেল একদিন, দুদিন, তিনদিন, চারদিন। তিনি ভাল করেই জানেন কেউ তাকে খোজ করবে না। সে পথ নিজেই বন্ধ করে এসেছেন। কদিন বাইরে থাকা তারজন্য স্বাভাবিক ঘটনা।
কাজেই তার পরিনতি হতে যাচ্ছে মৃত্যু। শেষপর্যন্ত চরম সিদ্ধান্তই নিতে হল তাকে। সাথে রয়েছে ছোট একখানা ছুরি। সেটাও চাইনিজ, একটুতেই ভোতা হয়ে যায়। সেটাই চালালেন নিজের হাতের ওপর। ওই ভোতা ছুরি দিয়েই হাত কেটে আলাদা করে পাথরের হাত থেকে মুক্ত হবেন। সেটাও ঘন্টার পর ঘন্টার প্রচেষ্ঠা। একসময় সফল হলে কনুই পর্যন্ত হাত বাদ দিতে।
এমন রোমাঞ্চকর দৃশ্য না দেখে পারা যায়!
সত্যি ঘটনার কথা যখন হচ্ছে তখন নিজের জীবনের সত্য উল্লেখ করলে ক্ষতি কি ?
ব্যক্তিগতভাবে নিজে তখন স্কুলের ছাত্র। বাস করতাম পদ্মা নদীর কাছাকাছি। যখন মাইলের পর মাইল বিশাল চর পড়ে তখন সেখানে বেড়াতে যাওয়া স্বাভাবিক বিষয়। একদিন কথায় কথায় একজনের সাথে বাজি ধরে সারারাত সেই চরে কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। চারিদিকে ঘন অন্ধকার, শেয়ালের ডাক, বালুঝড় এসবের মধ্যেও দিব্বি রাত কেটে গেল। সত্যি বলতে কি, সে অভিজ্ঞতা হাই ডেফিনিশন টিভিতে কেউ পাবেন না এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি।
বিপত্তি হল যখন আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে তখন। বাড়ির দিকে ফেরত আসার পথে দুজন পুলিশের সাথে দেখা। আর তারা মহানন্দে বিশাল আসামী ধরেছি মনে করে থানায় নিয়ে গেল।
সারা বিশ্ব মানুষকে অভিযানে যেতে উতসাহ দেয়। মানুষ তাতে সাড়াও দেয়। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের ফটোগ্রাফার বাদামী ভাল্লুকের পেটে যায়। সেটা দেখেও অন্যরা থামে না। মরতে একদিন হবেই, ঘরে শুয়েই হোক আর বাঘের পেটেই হোক। মানুষ যায় বিপদের মধ্যে। বিপদটা আসে প্রকৃতি থেকে। প্রকৃতি যত ভয়ংকর সেখানে যাওয়ার মজা তত বেশি।
বাংলাদেশেও আমরা পিছিয়ে নেই। মুসা-মুহিত যখন এভারেষ্টের চুড়ায় ওঠেন তখন আমরাও রাজপথে নেমে লাফালাফি করি। আমরা চাই বিশ্বের মানুষ আমাদের চিনুক, জানুক। বাঙালী সব পারে। তবে,
বাড়ির ছেলেকে বাইরে যেতে দেবেন না। বান্দরবনে গিয়ে পাহাড়ে উঠবে, বনের মধ্যে ঘুরবে ওসব চলবে না। পাহাড়ে ওঠাকে ভয় নেই, বনের বাঘ-ভাল্লুককে ভয় নেই। ভয় বাঘা-বাঙালীকে। সাথের ক্যামেরা, ঘড়ি, টাকা, জামাকাপড় থেকে শুরু করে জীবন পর্যন্ত হারাতে হতে পারে।
মীরপুরের কয়েকজন ছাত্র হয়ত এই নিয়ম মানতে চায়নি। সবেবরাতের রাতে মানুষ সারারাত নামাজ পড়ে। সারা বছরের আয় করে নিতে চায় একদিনেই। বহুদিন ধরেই এটা প্রচলিত। তারাও বেরিয়েছিল। তারপর একসময় মনে করেছে নদীর ধারে, মুক্ত যায়গায় কিছু সময় কাটিয়ে দেখা যাক। নিজেদের জীবন দিয়ে শখ মেটাতে হয়েছে তাদের। পাশের গ্রামের মানুষ তাদের পিটিয়ে মেরেছে ডাকাত সন্দেহে।
তাদেরকে ডাকাত প্রমান করার চেষ্টায় অবাক হবেন না। এটা প্রকৃতিগত। তাদেরকে নেশাখোর বানানোর চেষ্টায়ও অবাক হবেন না। কারন একই। তারা সেটা ছিল না জানিয়েছে তাদের এলাকার মানুষ। হাজার হাজার মানুষ পথে নেমেছে প্রতিবাদে। তারা বলছে, সিগারেট পর্যন্ত তারা খায় না। ওসব গাজা খাওয়ার গল্প গাজাখুরি।
আপনি এনিয়ে বহু মতবাদ তৈরী করতে পারেন। চাহিদা থাকলে ধারাবাহিক নাটকও তৈরী করা যায়। বাস্তবতা এটাই, গ্রামের মানুষকে নিজেদের অস্ত্রহাতে গ্রাম পাহাড়া দিতে হয়। সেখানে থানা-পুলিশ, আইন-প্রশাসন এদের অস্তিত্ব নেই। বিরোধী দলের হাজার হাজার কর্মীকে জেলে ঢোকানো সম্ভব কিন্তু ডাকাতকে জেলে ঢোকানো সম্ভব না।
সারা পৃথিবীতে গল্প-উপন্যাস-চলচ্চিত্রের বড় অংশ দখল করে রেখেছে এডভেঞ্চার। বাংলাদেশে চলচ্চিত্রে সেটা কখনোই ছিল না। গল্প-উপন্যাস থেকেও হারিয়ে গেছে। কে আর আজগুবি কথা বিশ্বাস করে। সামনে বাস্তব ঘটনা দেখে অনেকেরই প্রধান প্রশ্ন, তারা ওখানে যাবে কেন ?
ওসব অভিযান, ভ্রমন, শখ, এডভেঞ্চার এসব কথা ভুলে যান। বরং ড্রইং রুমে বসে ভিডিও দেখুন। এটাই নিরাপদ।

0 comments:

 

Browse