বাঙালী নিজেকে যতই বীর হিসেবে বর্ননা করুন, তিতুমীর-সুর্যসেনকে নিজেদের পুর্বপুরুষ হিসেবে প্রকাশ করুক, অন্যদের চোখে বাঙালী সবসময়ই নিরীহ জাতি। সে বৈশিষ্ট পুরোপুরি লোপ পেয়েছে মনে করারও কোন কারন নেই। এখনও দুদলে মারামারি লাগলে কেউ আগ বাড়িয়ে সেটা থামাতে যায় না, যতক্ষন নিজের লাভক্ষতির বিষয় না থাকে। সবসময়ই নির্ঝঞ্ঝাট জাতি হিসেবেই পরিচিত। এরই মধ্যে একবার ভিন্নরূপে দেখা দিল বাঙালী। সারা বিশ্ব কাপিয়ে দিল। একেবারে খালিহাতে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করল। সারা বিশ্ব অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল এক জাতিকে যারা জ্বলে-পুড়ে-মরে ছাড়খাড় তবু মাথা নোয়াবার নয়।
নতুন বাংলাদেশ নিয়ে সারা বিশ্বের তাই প্রশংসা আর আগ্রহের কমতি ছিল না। যেদিন রেসকোর্স ময়দানে রাজাকারের বিচারের দিন ঠিক করা হল সেদিন সারা বিশ্বের সাংবাদিকরা হাজির হয়েছিলেন নতুন বাংলাদেশের গতি দেখতে। রক্তের নদীতে যে দেশের জন্ম সেই দেশের মানুষ কিভাবে নিজেদের পথ ঠিক করে জানতে।
সেদিন বিচার হয়নি। হাজির করা চারজন রাজাকারকে সারা বিশ্বের সামনে বিনা বিচারে বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে মেরে ফেলা হয়। যে ন্যায়বিচার নিয়ে নতুন জাতির সৃষ্টি সেই ন্যায়বিচার পরিনত হয় আক্রোশ আর প্রতিহিংসায়। আইন প্রয়োজন নেই, বিচার প্রয়োজন নেই। ওরা যে কষ্ট দিয়েছে ওদেরকে কষ্ট দিয়ে তার শোধ নেয়া হবে।
সারা বিশ্বের মানুষ বুঝেছিল ধ্বংশ হয়ে যাওয়া একটা দেশের নিজের পায়ে দাড়ানোর জন্য সাহায্য দরকার। খাবার-জামাকাপড়-কম্বল থেকে শুরু করে বইখাতা-কলম-পেনসিল পর্যন্ত। দিতে দিতে একসময় হাফিয়ে গেল তারা। একসময় বলেই বসল এটা তলাবিহীন ঝুড়ি। এই ঝুড়ি ভরা সম্ভব না।
দেশের যিনি নেতৃত্বে তিনিও বিরক্ত এসবে। চারিদিকে সব চোর-চোট্টা। সোনার বাংলা গড়ার জন্য সোনার মানুষ চাই। কোথায় সেই সোনার মানুষ। সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য সাড়ে সাত কোটি কম্বল আনলাম, আমার কম্বল কোথায় ?
এরপর পদ্মা-যমুনায় বহু পানি গড়িয়েছে। বহুকিছু বদল হয়েছে। সবধরনের সরকার দেশ শাসন করেছে। এমনকি যদি রাজতন্ত্র বলতে চান সেটাও। সত্যি বলতে কি দেশে দুটি রাজবংশ বিদ্যমান। এর বাইরে কারো রাজ্যশাসন করার সম্ভাবনা নেই।
হাটি হাটি পা-পা করে চল্লিশ বছর। বিশ্বের আরেক দেশের তুলনা এখানে না করে পারা যায় না। বলা হয় সেখানে দুদলে বিরোধ ছিল মানবসভ্যতার ইতিহাসে নিকৃষ্টতম। একদলের গায়ের রং সাদা আরেক দল কালো। সাদার অধিকার কালোকে মারার, মেরে ফেলার। সেটাই আইন। ক্ষমতা তাদের হাতে। কালোদের যিনি নেতৃত্বে তিনি জীবনের অধিকাংশ সময় কাটালেন ছোট্ট এক ঘরে আটক থেকে। যেখানে দুহাত প্রসারিত করলে দুদিকের দেয়াল ছোয়া যায়। তারপর একসময় তার জয় হোল। তিনি ক্ষমতায় গেলেন। প্রথম কাজ হিসেবে আগের সরকারের লোকদের ডেকে বললেন, আপনারা যদি চাকরী ছাড়তে চান সেটা ইচ্ছে। আপনাদের ইচ্ছেয় বাধা দেয়ার অধিকার আমার নেই। কিন্তু যদি ভেবে থাকেন আমি অত্যাচারিত হয়েছি, কালোরা অত্যাচারিত হয়েছে বলে আপনাদের সাথে খারাপ আচরন করা হবে তাহলে আমি নিষ্চয়তা দিচ্ছি, সেটা হবে না। আমাদের কোন ভেদাভেদ নেই। আমরা একসাথে দেশ গড়ব। এটা রেইনবো নেশন। এখানে সব রঙের অধিকার সমান।
কদিন আগে যে নিরপত্তাকর্মী অস্ত্রহাতে তাকে মারার জন্য ঘুরেছে তাকেই নিজের নিরাপত্তার দায়িত্ব দিলেন। প্রিয়জনেরা আপত্তি করলে বললেন আমি নিজে যদি ক্ষমা করতে না পারি তাহলে অন্যদের কাছে ক্ষমা আশা করব কিভাবে ? জনগনকে বললেন, আমাকে নেতা হিসেবে ডেকেছ, নেতৃত্ব করতে দাও।
বলা প্রয়োজন নেই বর্তমানে দক্ষিন আফ্রিকা নামের সেই দেশ আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে উন্নত দেশ। এজন্য তাদের ৪০ বছর প্রয়োজন হয়নি।
বাংলাদেশে যারা যুদ্ধের বিরোধীতা করেছিল, মানুষ মেরেছিল, ঘরবাড়ি পুড়িয়েছিল তাদের কি ক্ষমা করা হয়েছে ? নাকি বিচার করে শাস্তি দেয়া হয়েছে ?
নিশ্চিত উত্তর নেই। একদিকে সাধারন ক্ষমা বলে একটি কথা প্রচলিত। অন্যদিকে আজও জনপ্রিয় শ্লোগান, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই। এই কথা বলে ভোট পাওয়া যায়। মানুষের বুক উথলে ওঠে এসব শুনে। দেশের বর্তমান-ভবিষ্যত জাহান্নামে যাক, চার দশক আগে ওরা যা করেছে সেজন্য ওদের শাস্তি দিতে হবে।
বাস্তবে যারা যুদ্ধাপরাধী তারা আছে, তারা থাকবে। তারা ক্ষমা পেয়ে সাধারন মানুষে পরিনত হবে না, শাস্তিভোগ করেও যুদ্ধাপরাধী নাম ঘুচাবে না। তারা এভাবে থাকলেই রাজনীতি করা সহজ।
কেউ এই রাজনীতির বাইরে না। শিক্ষাব্যবস্থা রাজনীতির জন্মদাতা। সেখানে তৈরী হচ্ছে নেতা। কেউ মুল রাজনীতিতে যোগ দিচ্ছেন সেখান থেকেই। তারপর বিস্তার ঘটাচ্ছেন শিক্ষাপ্রতিস্ঠানের বাইরে। কেউ যোগ দিচ্ছেন প্রশাসনে, কেউ আইন পেশায়, কেউ ব্যবসায়, কেউ হচ্ছেন শিল্পপতি। কেউ পরিনত হচ্ছেন বুদ্ধিজীবীতে। সবার মুখে একটাই কথা, রাজনীতি। এইদল নয়ত ওই দল। পক্ষে অথবা বিপক্ষে। সরকার, প্রশাসন, শিক্ষক, আইনজীবী, পুলিশ, আদালত, সংবাদমাধ্যম, রাষ্ট্রপতি কেউ বিতর্কের বাইরে নন।
পুরো সমাজে যখন এই অবস্থা থাকে তখন সমাজের শৃংখলা মাপার কোন মাপকাঠি থাকে না। সমাজ পরিনত হয় তলাবিহীন সমাজে।
0 comments:
Post a Comment