বাঙালীর হুজুগ বেশী। একথা বহুবার শুনেছি। এবং দেখেছিও। আর ঢাকা শহরে ? সেটা কি সারাদেশের চেয়ে বেশী ? না কম ? নাকি একইরকম ? আমার পক্ষে উত্তর দেয়া কঠিন। ইদানিং অনেকেই অনেক বিষয় নিয়ে গবেষনা করেন। এজন্য নাকি ফান্ড পাওয়া যায়। গবেষনার খরচ এবং নিজের খরচ দুইই চলে যায় তাতে। কেউ ইচ্ছে করলে একাজে হাত দিতেও পারেন। আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি, হুজুগ এখানে রয়েছে যঠেষ্ট পরিমানেই। অবশ্য যদি তাকে হুজুগ বলা যায়।
হুজুগ কাকে বলে ?
বড়ই বিপদে পড়লাম হুজুগের কথা তুলে। এর কোন ব্যাখ্যা কোন পাঠ্য-অপাঠ্য বইতে দেখেছি বলে মনে পরে না। আমি যেমনটা বুঝি তেমনটাই সহজভাবে বলার চেষ্টা করি। আমার মতে একজনের দেখাদেখি আরো কয়েকজন যদি একই কাজ করতে যায় তাকেই হুজুগ বলা যায়। কিছুটা ভুল হলেও হতে পারে, তবে আমার ধারনা এই ব্যাখ্যা ‘হুজুগ’ শব্দটির মোটামুটি পরিচয় বহন করে। সাথে দৃষ্টান্তও দিতে পারি। পথেঘাটে একটু লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন বহু লোকের, না শুধু লোক বললে ভুল হবে, শিশু, কিশোর, নরনারী, বৃদ্ধবৃদ্ধা যে কোন বয়সের যে কোন পেশার মানুষের চুলের রঙ কিছুটা বাদামী, কিংবা খয়েরী। বাঙালীর চুল বাদামী হয় না। এটা হুজুগ। কোন হেয়ার ড্রেসারে যেয়ে স্প্রে করলেই চুলের সেই অংশ বাদামী হয়ে যায়। আগে সেটা সাদা অথবা কালো যাই থাকনা কেন। অনেকে অন্য রঙও করেন। লাল, নীলচে, সবুজ। একজনকে দেখেছি তার পোশাকের সাথে মিল রেখে চুলের রঙ করতে। জুতা, প্যান্ট, সার্ট এই তিনরকম রঙ, পরপর, থাকে থাকে। এই রঙ টেকে বেশ কিছুদিন। এর খরচও খুব বেশী বলে মনে হয় না, কারন ফুটপাথের দোকানী, রিক্সাচালক এদেরও চুল বাদামী রঙ করতে দেখেছি। তবে টাকা খরচ হয়। একেবারে বিনাপয়সায় এই হুজুগে যোগ দেয়া যায় না।
বিনাপয়সার হুজুগে যোগ দেয়া সে তুলনায় সহজ। যদি রাস্তায় দেখতে পান কোথাও জটলা হচ্ছে তাহলে সাথেসাথে সেখানে গিয়ে একপাশে দাঁড়ান। ব্যাস, হয়ে গেল হুজুগে যোগ দেয়া। এরপর চলবে হুজুগে আপনার আগ্রহ কতখানি তারই পরীক্ষা। হুজুগ বেশী হলে ঠেলেঠুলে একেবারে কেন্দ্রে গিয়ে পৌছবেন, একে ওকে কনুই দিয়ে গুতা মেরে জানতে চাইবেন কি হয়েছে। উত্তর অবশ্য পাবেন একেকজনের কাছে একেকরকম, কিংবা কেউ উল্টো আপনাকেই প্রশ্ন করে বসবে। অন্তত আপনার পরে যে এসেছে সে তো বটেই। হয়ত একসময় দেখা যাবে আপনিই সেখানে সবচেয়ে প্রবীন সাক্ষী। আগের সবাই কেটে পরেছে, আর নতুন নতুন লোকের ভীড় বেড়েই চলেছে। আমি একবার এরকম এক ভীড়ে ‘কি হয়েছে’ জিজ্ঞেস করে যে উত্তরগুলি পেয়েছিলাম তার কয়েকটির নমুনা হচ্ছে, ‘একসিডেন্ট’ ‘রর্যাবে এ্যাটাক করছে’, ‘ছিনতাই’, ‘মারামারি’, ‘রিক্সার ভাড়া কম দিছে’, ‘কিছু না ভাই, হুজুগ’, ‘হানিফ সংকেত আইছে’, ‘আমি ক্যামনে কমু’ ইত্যাদি ইত্যাদি। ইচ্ছে করলে সত্যিকার কারনটা জানার জন্য অপেক্ষা করা যেত, কিন্তু একটু পরেই যা ঘটল তাতে আর সাহস পেলাম না। একজন যুবক- সে ছিনতাইকারী, কিংবা একসিডেন্টকারী ড্রাইভার, নাকি রিক্সার ভাড়া কম দেয়া প্যাসেঞ্জার অথবা অন্যকিছু যাই হোক, লোকের হাতে পরে গেল। অথবা লোকজন করার কিছু না পেয়ে তাকেই পাকড়াও করল। তাকে ঘিরে একটি ভিড়ই শুধু দেখতে পেলাম। ক্রমেই সেই ভিড় বাড়ছে, নতুন নতুন লোক যোগ দিচ্ছে। যারা একেবারে কেন্দ্রে পৌছেছিলেন, পরে তারচেয়েও শক্তিশালী কারো ধাক্কায় স্থানচ্যুত হয়েছেন, তারাও সন্তুষ্টই। অন্তত একটি ঘুসি বা একটি লাথি মারতে পেরেছেন। অল্পক্ষন পর সেখানে যোগ দিল পুলিশ। বাঁশি বাজাতে বাজাতে এসে ধাক্কাধাক্কি করে ভিড় সরিয়ে দিল। জীবিতই উদ্ধার করা সম্ভব হল সেই যুবককে। দেখা গেল সে একজন পথচারী। এখানে কি হয়েছে জানতে ঢুকেছিল।
আমার মনে হয় এখানে শুধুমাত্র হুজুগ শব্দটি ব্যবহার করলে ভুল হওয়ার সম্বাবনা থাকে। কিছুটা হুজুগ, কিছুটা আগ্রহ, দুইই বিদ্যমান। শুনেছি বাচ্চা এমুর আগ্রহ এতটাই বেশী যে মানুষকেও ভয় পায় না। দৌড়ে কাছে যায়, পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকে। তা একটি পাখির ছানা যদি এত আগ্রহী হতে পারে তাহলে মানুষের দোষ কি ? তারা কাছে গিয়ে জানতে চাইতেই পারে, কেসটা কি?
ভিড় তৈরীর সহজ একটি পন্থার বর্ননা দিয়েছিলেন কে যেন। আপনি রাস্তায় চলতে চলতে হঠাৎ করেই একযায়গায় দাঁড়িয়ে পরুন। তারপর নিবিষ্টভাবে তাকিয়ে থাকুন কোন একদিকে। সেটা রাস্তার কোন বিজ্ঞাপনের দিকেই হোক, কারো বাড়ির জানালার দিকেই হোক, কোন ব্যক্তির দিকেই হোক আর পরিস্কার আকাশের দিকেই হোক, তাতে কিছু যায় আসে না। একটু পরেই আপনার একজন সঙ্গি এসে জুটবে। সেও সেদিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করবে আপনি কি দেখছেন। আপনাকে প্রশ্ন করবে। যদি বিষয়কে আরো উসকে দিতে চান তাহলে তাকে শুধু বলুন, ‘দেখেছেন?’ সে আরো মনোযোগ দিয়ে মর্মোদ্ধার করতে চেষ্টা করবে। ততক্ষনে জুটে যাবে আরো কয়েকজন। এ ওকে দেখাবে, সে তাকে দেখাবে। তখন সাবধানে একপাশে একটু দুরে সরে যান। দেখবেন ভিড় বাড়তেই থাকবে, নানারকম মত কানে আসতে শুরু করবে। একসময় সেখানে পুলিশ এসেও হাজির হতে পারে। তবে ভয়ের কিছু নেই। পুলিশ এতে অভ্যস্থ। তারা অন্তত জানে তাদের সববিষয়ে নাক গলাতে হয় না। বরং কোন কোন ঘটনা থেকে নিজেদেরকে যতটা দুরে রাখা যায় ততই মঙ্গল। এক দোকানে ভিড় জমানোর জন্য এক অভিনব পন্থা অবলম্বন করতে দেখেছি। ‘আমি চোর’ লিখে একজন সুবেশী যুবকের গলায় ঝুলিয়ে দরজার কাছে দাঁড় করিয়ে রাখা। সাথে সাথেই ভিড় জমে যেত সেখানে। দেশে যখন সার্কাসের চল উঠেই গেছে তখন বিনেপয়সার সার্কাস দেখতে ছাড়ে কে ?
একবার রিক্সায় করে যেতে দেখলাম একযায়গায় বেশ ভীড়। সেদিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম কি হচ্ছে। আমার রিক্সাচালকও রিক্সা থামিয়ে দিল একপাশে। বোধহয় আমার দেখার সুবিধা করার জন্যই। আমি যতটা পারি দেখলাম রিক্সায় বসে থেকেই। অন্তত দাঁড়ানো লোকগুলির মাথার ওপর দিয়েই আমি দেখতে পেলাম কিছুটা। দেখেই চিনলাম, একজন টিভি তারকা। দাঁড়িয়ে রয়েছেন। দুপাশে দুজন বড় আয়না ধরে দাঁড়িয়ে। সামনে একজন কাঁধে ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে। নিশ্চয়ই নাটক। এখন এখানে হচ্ছে, পরে টিভিতে দেখানো হবে। বুঝতে পেরে আমার আগ্রহ কমে গেল। বরং টিভিতেই দেখে নেব একথা ভেবে রিক্সাচালককে সামনে যেতে বললাম।
আমাকে অবাক করে দিয়ে সে বলল, ‘অন্য রিক্সা নিয়া যান।’
আমি দোটানায় পরলাম। অর্ধেক রাস্তা এখনো বাকি, এখন অন্য রিক্সা নিলে অনর্থক বেশী খরচা। আর অন্য রিক্সাঅলাই বা যাবে কেন খেলা না দেখে! টাকার কথায় কাজ হবে ভেবে সেটাই বললাম। বললাম, ‘তোমার ভাড়া?’
‘লাগব না, যান গা।’ সে একেবারেই গা করলনা।
ভাড়া লাগবে না! যতদুর এসেছি সেজন্য তাকে কোন টাকা দিতে হবেনা! আমি বাক্যব্যয় না করে নেমে পড়লাম। একবার ভাবলাম তাকে এই সুযোগ করে দেয়ার জন্য তারকাছেই কিছু দাবী করব কিনা। পরে ভেবে দেখলাম সেটা করতে হলে আমাকে আরো বহুবছর ঢাকায় থাকতে হবে। এখনও সে যোগ্যতা অর্জন করিনি।
কোন চিত্রতারকা বা টিভিতারকা যদি তাদের নাগালে এসে পরেন তাহলে কি হতে পারে ভাবতে ভাবতে হেঁটেই রওনা হলাম। ভেবে যা পেলাম তা হচ্ছে তারা প্রত্যেকেই তার একটি করে চুল ছিঁড়ে নেবেন, যদি শেষ হওয়ার আগেই তারকাছে পৌছাতে পারেন। তারপর বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনকে দেখিয়ে উল্লাস করবেন, এটা অমুকের চুল, নিজের হাতে ছিঁড়ে এনেছি।
এজন্যই তারা পথেঘাটে বের হন না।
0 comments:
Post a Comment