আমার কলেজ জীবনে একজন বিজ্ঞানের শিক্ষক ডারউইন পড়াচ্ছিলেন। একসময় তিনি বললেন, বিজ্ঞানীরা বলেন বিশ্ব এবং জীবন সৃষ্টি হয়েছে বিবর্তনের মাধ্যমে আর ধর্ম বলে বিশ্ব এবং জীবন সৃষ্টি হয়েছে সাত দিনে। আমি এই দুইয়ের রহস্য বের করেছি। তখন একেকটা দিন ছিল বহু বছরের সমান। মৌখিক হিসেবের সুবিধার্থে যদি ধরেও নেই সৃষ্টির শুরু থেকে বর্তমানের মানুষ হতে সময় লেগেছে সাড়ে তিনশ কোটি বছর তাহলে তখন একেকটা দিন ছিল পঞ্চাশ কোটি বছরের সমান। সৃষ্টিকর্তার অসাধ্য কিছু নেই। তিনি সবই করতে পারেন।
এটা উদাহরনযোগ্য কম্প্রোমাইজ।
তাকে বিজ্ঞানে বিশ্বাস করতে হয় কারন তিনি বিজ্ঞান পড়েছেন এবং পড়াচ্ছেন। শিক্ষার আলো ছড়িয়ে মাস মাস বেতন পাচ্ছেন। তাকে ধর্ম মানতে হয় কারন তিনি বাংলাদেশের ধার্মিক মুসলমান। কাজেই সৃষ্টির সময়কালে যদি সুর্য থেকে পৃথিবীর দুরত্ব, গতিবেগ, মহাজাগতিক প্রভাব এগুলি পরিবর্তন হয়েও থাকে তাহলে তা দুপক্ষই রক্ষা করে।
বলা উচিত তিনপক্ষ কারন তিনি তৃতীয় পক্ষ হিসেবে এই মহামুল্যবান তত্ত্ব আবিস্কার করেছেন। ধর্ম এবং বিজ্ঞানে কম্প্রোমাইজ করেছেন। এবং দেখিয়েছেন কম্প্রোমাইজ সুত্রে খুব সহজে সমস্যার সমাধান করা যায়।
কম্প্রোমাইজ সুত্রের ব্যবহার কখন থেকে শুরু হয়েছে তা নিয়ে গবেষনা করা যেতে পারে। এতে অন্তত কয়েকশ বছর পাওয়া যাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। হয়ত হাজার বছর। কারন আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য অনেক পুরনো। কম্প্রোমাইজের বিষয়টিও একেবারে রক্তে মিশে গেছে। ছোট-বড়, জ্ঞানী-মুর্খ, ধনী-গরীব, ধার্মিক-নাস্তিক কোথাও কমতি নেই।
ধরুন শিক্ষকের কথা। শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেবেন সমাজে। কিন্তু তার নিজের ঘর থাকে অন্ধকার। বেতনের টাকায় খাবার জোটে না, নিজের ছেলেমেয়েকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনার অবস্থা। নীতির ব্যবহারে একটুখানি কম্প্রোমাইজ। ক্লাশে সময়মত যাবেন, ক্লাশ নেবেন আর সুযোগমত জানিয়ে দেবেন যেটুকু ঘাটতি থেকে গেল তা পুরন করার জন্য যেতে হবে বাসায়। সেখানে কয়েকখানা বেঞ্চ পাতা হল। একবেলা ক্লাশ নেয়ার পর আরেকবেলা ক্লাশ। প্লেটোও সেটা করতেন। একবেলা একাডেমির ছাত্রদের ক্লাশ নিয়ে আরেকবেলা এথেন্সবাসীর ক্লাশ নিতেন। কাজেই এই শিক্ষক কোন অন্যায় করছেন না। শিক্ষার প্রসার ঘটাচ্ছেন।
এরপর ধাপে ধাপে উন্নতি। বেঞ্চের সংখ্যা বাড়ল। একসময় তাতেও যায়গা কুলায় না। নতুন যায়গা, নতুন ঘর ভাড়া করতে হল। রাস্তায় রাস্তায় বিজ্ঞাপন দিতে হল। অমুক স্যার তমুক যায়গায় পড়ান। শাখা রয়েছে এখানে, ওখানে, সেখানে। ততদিনে কম্প্রোমাইজ ভালভাবে জেকে বসেছে। একই স্যার একডজন যায়গায় কিভাবে ক্লাশ নেন সে প্রশ্নটিও হারিয়ে যায়। ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠান। স্যার থেকে কোচিং সেন্টার, কোচিং সেন্টার থেকে স্কুল, স্কুল থেকে স্কুল ও কলেজ, তারপর ইউনিভার্সিটি। দেশে বসে বিদেশী ডিগ্রী।
চাকরীজীবির কথাই বা বাদ দেবেন কেন। তাকেও বেতনের টাকা হিসেব করে চলতে হয়। তাতে কি আসলে চলে ? বাড়িভাড়া, খাবার খরচ, যাতায়াত খরচ, ছেলেমেয়ের স্কুল খরচ, আরো কতরকম ধানাই-পানাই। বেতনের টাকায় যাতায়াত খরচ হয় বড়জোর। তখন প্রয়োজন হয় কম্প্রোমাইজ। যদি কাজ করতে চান তাহলে কম্প্রোমাইজ করুন। আপনার উপকার আমারও উপকার। সমাজে উপকারের চেয়ে ভাল কিছু নেই।
কিংবা ব্যবসায়ী, কিংবা শিল্পপতি। যা লাভ হয় তাথেকে কর্মচারীদের বেতন, খরচাপাতি, বিদ্যুৎ-গ্যাস, ট্যাক্সঅলা এতজনকে দেয়া যায় না। একটুখানি কম্প্রোমাইজ। বিদ্যুৎ-গ্যাসের লোক খুশি, ট্যাক্সঅলারা খুশি, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিও খুশি। খুশির চেয়ে ভাল জগতে আর কি থাকতে পারে!
কিংবা সৎ জীবনযাপনের কথাই ধরুন না কেন। ধার্মিক হয়ে সৎভাবে চলতে গেলে অনেক নিয়মকানুন মানতে হয়। দানখয়রাত করতে হয়। হজ্ব পালন করতে হয়। একটুখানি কম্প্রোমাইজ। ইচ্ছেমত দান খয়রাত করার সুযোগ হাতে এসে গেল। নবীর শিক্ষা কোরনা ভিক্ষা, ওটা বানানো কথা। আজকাল ধর্মের ওই নিয়ম চলে না। কেউ যদি ভিক্ষে না করে তবে দান করবেন কাকে। দোয়া কামাবেন কিভাবে। টাকাপয়সা তো পরকালে সাথে নেয়া যায় না, ওই দোয়াটাই নিতে হয়।
অবস্থা ভালর দিকে গেলে চাইলে প্রতিবছর হজ করতে পারেন। ধর্মে হজ বাধ্যতামুলক। যাওয়ার সময় কিছু নিয়ে যাবেন, আসার সময় কিছু সাথে আনবেন। খরচ উঠে এল। রথ দেখা কলা বেচা দুইই হল। মাঝখানে নামের সাথে হাজি যোগ হল। সবদিকেই লাভ।
আর রাজনীতির কথা যদি বলেন, সেখানে কম্প্রোমাইজই মুলকথা। এটা যেহেতু নীতির রাজা সেহেতু সবকিছু নিয়ন্ত্রন করে এটাই। রাজা যা বলবেন প্রজার কর্তব্য সেটা মেনে চলা। কালো টাকার মালিক হয়েছেন, কোন সমস্যা নেই। একটুখানি কম্প্রোমাইজ করুন। ঘরবাড়ি-জমিজমা কিনুন, শেয়ার কিনুন। টাকা খাটান। কেউ প্রশ্ন করবে না টাকা সাদা না কালো।
পলিটিক্স ইজ আর্ট অব কম্প্রোমাইজ, বলেছেন টাকামন্ত্রী।
0 comments:
Post a Comment