গনতন্ত্রের সার্কাস

Oct 2, 2011
বাংলাদেশের স্কুলের পাঠ্যবইতে লিংকনের গ্যাটিসবার্গ এড্রেস পড়ানো হয়। ফল হয়েছে এটাই যে কারো যদি ইয়েস-নো-ভেরি গুড পর্যায়ের ইংরেজিও জানা থাকে সে দিব্বি গনতন্ত্রের সংজ্ঞা আউড়ে যেতে পারে। গনতন্ত্র নিয়ে কথবার্তা উঠলে আবৃতি করে দিতে পারে দুলাইন। আর নির্বাচনের প্রসংগ থাকলে তো কথাই নেই। আমরা দেখে শুনে বুঝে যাচাই করে সত, প্রতিভাবান, দেশপ্রেমিক, যোগ্য ব্যক্তিকে ভোট দেব। আগে অনেক ভুল করেছি, আর ভুল করছি না। এবার ভোট দিয়ে গনতন্ত্র হাজির করে ছাড়ব। ব্যাটা যাবে কতদুর ?
সংসদ কতটুকু গনতন্ত্র দেয় সে প্রশ্ন করেছিল গাই ফকস নামে এক বৃটিশ ৪০০ বছর আগে। গনতন্ত্র মানে সুন্দর একখানা বিল্ডিং এ বসে বড়বড় বুলি কপচানো না, জনগনকে পিটিয়ে অনুগত রাখা না। গনতন্ত্র মানে জনগনের উপকার করা। এমন একটা ব্যবস্থা যেখানে জনগন সরকারকে ভয় করে না, সরকার জনগনকে ভয় করে। তার সেই বক্তব্য সে মুখে বলেই ক্ষান্ত হয়নি, রীতিমত বারুদ দিয়ে উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেছিল পার্লামেন্ট বিল্ডিং। জনগনের ওই বিল্ডিং প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন বেচে থাকার মত আশা।
বর্তমানে নিশ্চয়ই কেউ সে চেষ্টা করবেন না। বাংলায় সন্ত্রাসী কিংবা ইংরেজি টেররিষ্ট এই শব্দ এমনভাবে আপনার মাথায় গেথে দেয়া হয়েছে যে আপনি নিশ্চিত জানেন এটা টেরোরিজম। ধরা পড়লে এমনকি সন্দেহ করলেও হাজত-রিমান্ড-জেল-মৃত্যুদন্ড সবকিছুই হতে পারে। একদল সাধারন মানুষ যখন খাবার না জোটায় প্রতিবাদে পথে নামে, যখন তাদের বিপরীতে ইউনিফর্ম পড়নে অস্ত্র হাতে মানুষ দাড়ায়, গুলি চালায় তখনো যারা খালি হাতের মানুষ তারাই টেররিষ্ট, তারাই সন্ত্রাসী। দেশকে ধ্বংশ করার ষড়যন্ত্র করছে। এদের জন্য আদালত আর জেলখানা। যারা কলকাঠি নাড়ছে তাদের জন্য শীতাতপনিয়ন্ত্রিত সংসদ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাড়ি আর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ি। আর উর্দিপড়া অস্ত্রহাতে পাহারাদার। গনতন্ত্র মানে নেতার কথায় হাততালি দেয়া। মাথা নিচু করে হাত পাতুন সেখানে কিছু পাবেন। সেটা না করলে উচু মাথা নিচু করে দেয়া হবে।
বাংলাদেশের সচেতন বাঙালীর সচেতনতা অন্যদের থেকে অনেক বেশি। লোকে বলে আমেরিকানরা নাকি পকেটে টাকা থাকলে দেশের প্রেসিডেন্ট কে সেটা নিয়েও মাথা ঘামায় না। ধুরো, ওরা মানুষ নাকি ?
মানুষ তো তারাই যারা রাজনীতির খোজ রাখে। রিক্সা চালানোর ফাকে ফাকে কিছুক্ষন চায়ের দোকানে বিশ্রাম, চা খেয়ে সিগারেটের ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে রাজনীতির আলাপ। কিংবা অফিসে বসে খবরের কাগজ সামনে রেখে কোন নেতা কি বললেন তার বিশ্লেষন। ছাত্র হলে তো কথাই নেই। জানেন না এদেশের ছাত্র রাজনীতির গৌরবের ইতিহাস। পাবেন অন্য কোন দেশে ? ওরা তো ভেড়ার মত বই নিয়ে পড়ে থাকে। চোখকান থাকলে তো রাজনীতি করবে!
আর যদি বুদ্ধিজীবি হন তাহলে-
বুদ্ধিই যখন জীবিকা তখন বুদ্ধির কথাই তো বলবেন। একমাত্র বুদ্ধিমানই জানে কখন কোন পক্ষে কথা বললে লাভ। চৈত মাসের ফতোয়া মাঘ মাসে চলে না। কাজেই গনতন্ত্রের কথা যদি শুনতে হয় তাদের কাছেই শুনুন।  
গনতন্ত্র হচ্ছে গনতন্ত্রের মানষকন্যার অবদান। তিনি সংবিধান পরিবর্তন করে অংসবিধানিক-অগনতান্ত্রিক পথে ক্ষমতায় আসার পথ বন্ধ করেছেন। ওই মিলিটারী বলুন আর অনির্বাচিত তত্তাবধায়কই বলুন কারো সাধ্য নেই ক্ষমতায় যায়। হে-হে-হে সংবিধানে লেখা আছে। না মানলে সংবিধান লংঘন। এক্কেবারে ফাসি। ওইসব ধানাই পানাই ছাড়ুন। গনতন্ত্রের পথে চলুন। সরকারের প্রশংসা করুন। সরকারকে সহযোগিতা করুন। সবধরনের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। রাজপথে মিছিল করে দেশের শান্তি নষ্ট করবেন, দুর্নীতির বিচারে বাধা সৃষ্টি করবেন ওসব করতে দেয়া হবে না।
বিপরীতমুখি বুদ্ধিজীবিও খুব কম নেই। তারা একসময় লাভ পেয়েছেন, ভবিষ্যতে আবারো পাওয়ার আশা করেন। গনতন্ত্রের কথা তাদের মুখেই ভাল মানায়। সরকার ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করার জন্য পা তুলে আছে। ওইযে নতুন নতুন গ্যাস পাওয়ার কথা বলছে, ওইটা হইল নতুন চালাকি। আগেরবার যখন ক্ষমতায় ছিল তখনই কইছিল বাংলাদেশ ত্যাল-গ্যাসের উপর ভাসতাছে। নিজেদের জন্য রাইখ্যা বাকিটা ভারতে রপ্তানি করব। সেই ত্যাল-গ্যাস গেল কই ?
নদী নিয়া চুক্তি করছে সেই চুক্তি তো আছে, পানি কই ? পার্বত্য শান্তি চুক্তি তো যুগ পার করছে সেইখানে শান্তি কই ? দশ টাকা কেজি চাল, বিনামুল্যে সার সেইগুলান কই ? নদীর উপরে ব্রিজ, নিচে টানেল, উড়াল সেতু সবকথা শুনতাছি কিন্তু যুগ যুগ ধইরা যে পথে মানুষ চলত এখন সেই পথেও চলা যায় না। এইডা কেমন উন্নয়ন। কেমুন গনতন্ত্র।
এই বহুমুখি গনতন্ত্রের বক্তব্যে শুনতে শুনতে কেউ বলতে পারেন, আরে বাবা গনতন্ত্র কি বহুরুপি নাকি। একেক জনের কাছে একেক রকম। কারো কাছে সাদা কারো কাছে কালা কারো কাছে লাল কারো কাছে হলুদ। গনতন্ত্র কি সার্কাসের সঙ।
গাই ফকসকে ফাসিতে ঝুলানো হয়েছিল। এভাবে মৃত্যু না হলে অন্যভাবে তার মৃত্যু হত। ৪০০ বছর কেউ বাচে না। বরং ফাসিতে ঝুলে সে বেচে আছে। ৫ই নভেম্বর পালন করেন অনেকে। যতদিন নেতারা জনগনের মাথায় চেপে ছড়ি ঘোরাবেন, গনতন্ত্রের সার্কাস যতদিন চলবে ততদিন এটা চলতেই থাকবে।

0 comments:

 

Browse